আন্তর্জাতিক

তাজমহলের বন্ধ ২২ দরজার পেছনের রহস্য

তাজমহলের রহস্যময় ২২ বন্ধ কক্ষের দরজা খুলতে বিজেপি নেতার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে ভারতের আদালত।

বিজেপি নেতা রজনিশ সিং তার আবেদনে দাবি করেন তাজমহলের ২০টিরও বেশি ‘স্থায়ীভাবে তালাবন্ধ’ কক্ষগুলো খুলে দেওয়া হোক যাতে ‘এই সৌধের প্রকৃত ইতিহাস’ বেরিয়ে আসে।

তিনি দেখতে চান তাজমহলের ভেতরের তালা দেওয়া ঘরগুলোতে হিন্দু দেবতা শিবের একটি মন্দির রয়েছে বলে যে ‘দাবি ঐতিহাসিকরা এবং ভক্তরা করেন’- তা যথার্থ কিনা।

আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে অসামান্য সুন্দর এই সৌধটি তৈরি হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার মৃত স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি ধরে রাখতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন।

ইট, লাল রংয়ের পাথর এবং সাদা মার্বেলের তৈরি এই সৌধটি জুড়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য আর শিল্পকলা সারা পৃথিবীর মানুষকে মুগ্ধ করেছে। তাজমহল শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের মধ্যেই পর্যটনের অন্যতম প্রধান একটি আকর্ষণ।

কিন্তু তাজমহল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে সন্তুষ্ট নন বিজেপির রাজেশ সিং। ‘বন্ধ দরজাগুলোর ওপাশে কী আছে তা আমাদের জানা উচিৎ’, আদালতে বলেন তিনি।

তালা দেওয়া যে কক্ষগুলোর কথা মি. সিং তুলছেন সেগুলোর অধিকাংশই সৌধের ভূগর্ভস্থ অংশে অবস্থিত। তাজমহলের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন এমন অনেক মানুষের মতে, ভূগর্ভস্থ ঐ ঘরগুলোর ভেতর আদৌ কোনো রহস্য নেই।

কক্ষগুলো নিয়ে এক তাজ বিশেষজ্ঞের বয়ান

মোগল স্থাপত্যের একজন শীর্ষ বিশেষজ্ঞ এবা কোচ, যিনি তাজমহলের ওপর গবেষণাধর্মী একটি বই লিখেছেন, তার গবেষণার সময় ঐ সমস্ত কক্ষ এবং ভেতরের সমস্ত প্যাসেজ বা পথের ভেতর ঢুকে খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং ছবি তুলেছেন।

তিনি লিখেছেন, তাজমহলের নিচে ভূগর্ভস্থ ঐ কক্ষগুলো তৈরি করা হয়েছিল ‘তাহখানা’র অংশ হিসাবে। মোগলরা গরমের মাসগুলোতে শীতল থাকতে এমন ভূগর্ভস্থ কক্ষ তৈরি করতো।

সৌধের নিচে নদীমুখী একটি চত্বরে সারিবদ্ধ বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। মিজ কোচ নদীর সমান্তরাল এরকম ১৫টি কক্ষের কথা লিখেছেন। সরু একটি করিডোর দিয়ে ঐ চত্বরে যাওয়া যায়।

এগুলোর মধ্যে সাতটি কক্ষ বেশ বড় – যেগুলোর প্রতিটির দুই দেয়ালে বর্ধিত অংশ রয়েছে। ছয়টি কক্ষ চার দেয়ালের এবং দুটি কক্ষে দেয়ালের সংখ্যা আটটি করে।

বড় আকৃতির কক্ষগুলোর সামনে রয়েছে কারুকার্য খচিত খিলান বা তোরণ – যেগুলোর ভেতর দিয়ে যমুনা দেখা যায়।

ঘরগুলোর সাদা চুনকাম করা দেয়ালের নিচে মিজ কোচ “রঙিন কারুকার্যের” নমুনা দেখেছেন।

‘এটা নিশ্চিত যে সম্রাট যখন এই সৌধে আসতেন তখন এসব প্রশস্ত, সুন্দর এবং শীতল কক্ষগুলো ছিল তার, সহযোগীদের এবং তার নারীদের আদর্শ বিশ্রামের জায়গা,’ লিখেছেন মিজ কোচ যিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান আর্টস বিভাগের একজন অধ্যাপক।

এধরণের ভূগর্ভস্থ গ্যালারি মোগল স্থাপত্যের অংশ ছিল। পাকিস্তানের লাহোরে মোগলদের একটি দুর্গে জলাধারের সমান্তরাল এমন সার দেওয়া ভূগর্ভস্থ কক্ষ রয়েছে।

সম্রাট শাহজাহান অনেকসময় যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় করে তাজমহলের আসতেন। সিঁড়ি বাধানো একটি ঘাটে নেমে তাজমহলে ঢুকতেন তিনি।

ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষক অমিতা বেগ ২০ বছর আগে তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ঐ অংশে ঢুকেছিলেন। তিনি পরে লেখেন, ‘সেখানে গিয়ে চমৎকার কারুকার্যে মোড়া একটি করিডোর দেখেছিলাম। ঐ করিডোর দিয়ে প্রশস্ত একটি চত্বরে যেতে হয়। পরিষ্কার বোঝা যায় সম্রাট এই করিডোর দিয়ে ঢুকতেন।’

আগ্রায় বড় হওয়া দিল্লির ইতিহাসবিদ রানা সাফাভি বলেন, ১৯৭৮ সালে এক বন্যার আগ পর্যন্ত তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ঐ অংশে পর্যটকরা যেতে পারতেন।

‘বন্যার পানি তাজমহলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল, পানি নামার পর মাটির নিচের ঐ ঘরগুলোর মেঝেতে পলির আস্তরণ পড়েছিল। দেয়ালে, মেঝেতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। তারপরই কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের জন্য ঘরগুলোতে ঢোকা বন্ধ করে দেয়। ওগুলোর ভেতর কিছুই নেই’, বলেন মিজ সাফাভি।

শুধু মাঝেমধ্যে সংস্কার কাজের জন্য ঘরগুলো খোলা হয়।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker