সম্পাদকীয়তথ্য ও প্রযুক্তি

মনিটাইজড সমাজ: যেখানে প্রতিভা নয়, ভাইরালই পরিচয়

মিশন নাইনটি নিউজের বার্তা সম্পাদক ও রিপোর্টার জীবন আহমেদ রাব্বির কলামে উঠে এসেছে এক নতুন সামাজিক বাস্তবতার চিত্র; যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার মনিটাইজেশন প্রতিভা নয়, বরং ভাইরালিটিকেই সাফল্যের একমাত্র মানদণ্ড করে তুলেছে, যা গভীর মানবিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে

যে দেশে একসময় ‘লেখক’ শব্দটা উচ্চারিত হত গভীর শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ের সাথে, সেই দেশেই এখন সবাই কনটেন্ট ক্রিয়েটর। যার হাতে মোবাইল আছে, সেলফি স্টিক আছে, কিংবা সামান্য সময় ও সাহস আছে সেই হয়ে উঠছে কনটেন্ট ক্রিয়েটর।

কনটেন্ট ক্রিয়েটরের নতুন সংজ্ঞা:

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই কনটেন্ট ক্রিয়েটর হতে আর কিছুর দরকার হয় না। না আছে নিরীক্ষা, না আছে গবেষণা, না আছে ভাষার সৌন্দর্য। দরকার শুধু মনিটাইজড পেজ কিংবা ফেসবুক আইডি, স্টোরি বা ভিডিও পোস্ট, আর কিছু স্টার, ফলোয়ার, কিংবা ভিউ। যেন ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মগুলো নতুন এক চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কোথাও আবেদন করতে হয় না, কোথাও সাক্ষাৎকার নেই, যোগ্যতা যাচাইয়ের প্রশ্ন তো দূরের কথা।

ফেসবুক পেজ খুললেই এখন লেখা থাকে “Professional Mode On”। মুহূর্তেই আপনি কনটেন্ট ক্রিয়েটর। তাতে আপনি কী কনটেন্ট বানাচ্ছেন, কী ভাষা ব্যবহার করছেন, তার কোনো মানদণ্ড নেই। কেউ লাফিয়ে পড়ে পুকুরে, কেউ গলায় ঝুলিয়ে নেয় গরুর ঘন্টা, কেউ মুখে গুল নিয়ে গরুর দুধ বের করেন! তবু সবই কনটেন্ট। যত হাস্যকর, তত ভাইরাল

মনিটাইজেশনের মোহে:

এই মনিটাইজেশনের মোহে এখন প্রত্যেকে ভাবছে “আমি কেন পিছিয়ে থাকব?” বাড়ির গৃহিণী থেকে শুরু করে স্কুল পড়ুয়া ছাত্র সবার চোখে এখন নিজেদের ফেসবুক আইডি বা পেইজের “কনটেন্ট মনিটাইজেশন” অপশনের দিকে। গানের গলা নেই? সমস্যা নেই, রিল বানান। ভালো নাচ জানেন না? তাও সমস্যা নেই, ট্রেন্ডিং মিউজিকে দুই ঠোঁট নাড়ালেই হবে।

এই কনটেন্ট ক্রিয়েটর সংস্কৃতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এর মাধ্যমে প্রতিভা নয়, ভাইরালিটিই হয়ে উঠছে মূল সাফল্যের মানদণ্ড। আপনি যদি মানুষের অনুভূতিকে স্পর্শ করতে না পারেন, কিছু বলার নেই। কিন্তু যদি আপনি পাগলামো করে ১০০K ভিউ পান, আপনি তখন প্রশংসিত শিল্পী!

যা হারাচ্ছি আমরা:

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ক্রমাগত মনিটাইজেশন আর সস্তা কনটেন্টের ভিড়ে আমরা কী হারাচ্ছি? হারাচ্ছি আমাদের সময়, মান, গভীরতা আর অন্তর্দৃষ্টিকে। হারাচ্ছি আমাদের ছোট ছোট উপলব্ধির জায়গা যেখানে আগে আমরা গান শুনতাম চোখ বন্ধ করে, এখন শুনি স্ক্রিনে চোখ রেখে, ব্যাকগ্রাউন্ডে স্ক্রল করে।

সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো এই কনটেন্ট দুনিয়ায় মানুষ এখন নিজের জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে উৎপাদনশীল করে তুলতে চায়। সন্তানকে আদর করা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, মা-বাবাকে খাওয়ানো সব কিছুই রিলে বা ভিডিওতে বন্দি। জীবন নয়, ক্যামেরার জন্য মুহূর্ত বানানোই এখন অভ্যাস

মনুষ্যত্ব ও পণ্যায়ন:

আমরা ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছি সব কিছুর মূল্য টাকা নয়, এবং সব কিছুকে পণ্য করে তোলা যায় না। শুধু টাকা তোলার আশায় বা একটুখানি ভিউ পাওয়ার জন্য যদি আমরা আমাদের ব্যক্তিত্ব, সম্পর্ক আর নৈতিকতা বিসর্জন দিই তাহলে আমরা কেবল কনটেন্ট ক্রিয়েটর হচ্ছি না, হয়ে যাচ্ছি মননের বেওয়ারিশ

সবাই কনটেন্ট বানাক, এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ভাবনার দেউলিয়াত্ব, দায়িত্বহীনতা আর মর্যাদাহীন প্রকাশ যদি প্রাধান্য পায়, তাহলে এই মনিটাইজেশন একদিন মনুষ্যত্বকেই ডিমনিটাইজ করে দেবে

তাই সময় এসেছে নিজেকে প্রশ্ন করার— আমি কি কনটেন্ট তৈরি করছি, নাকি কনটেন্টের নামে নিজের অস্তিত্ব হারাচ্ছি?

Author

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker