স্বপন মাহমুদ, জামালপুর প্রতিনিধি:
কাগজ-কলমে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী থাকলেও বাস্তবে নেই কোন শিক্ষার্থী। দপ্তরির দিতে হয় না ঘন্টা! স্কুল মাঠে অবসর সময় কাঠিয়েই শিক্ষকদের পার হচ্ছে দিন। মাস শেষে তুলছেন হাজার হাজার টাকার বেতন ভাতা।
এমপিওভুক্ত এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র মিলেছে জামালপুরে সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের চাপারকোনা মনিজা আবুল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৮৭ইং সালে এলাকার কিছু শিক্ষানুরাগী নিজস্ব জমি ও অর্থায়নে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৯৭ইং সালে ১২ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গত মঙ্গলবার ও রবিবার (৩ মার্চ) সকাল ১১ টায় ৬ষ্ঠ শ্রেণী হতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণি কক্ষই শিক্ষার্থী শূন্য। শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চগুলো খুব সুন্দর সাজিয়ে। তবে দীর্ঘদিন ব্যবহৃত না হওয়ায় ধুলাবালির স্তুপে ঢেকে বেঞ্চগুলো। অফিস কক্ষে নেই প্রধান শিক্ষক। সহকারী শিক্ষকরা কর্মচারীদের নিয়ে স্কুল মাঠে বসে গল্প করছে। এছাড়াও দেখা গেছে শিক্ষার্থী ছাড়াই শিক্ষার্থীদের হাজিরা খাতায় সন্তোষজনক উপস্থিতি লিখে রাখা হয়েছে। আর এসব কর্মকাণ্ড দেখে শিক্ষকদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন অভিভাবক ও স্থানীয়রা।
স্থানীয় হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বাড়ির পাশেই মনিজা আবুল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। কিন্তু এখানে লেখাপড়া হয় না। শিক্ষকরা শুধু আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়। কয়েকজন শিক্ষার্থী মাঝে মধ্যে আসলেও ঘন্টাখানেক পরই আবার চলে যায়। তাই আমাদের মেয়েকে এখানে ভর্তি করিনি। আধ মাইল দূরের স্কুলে ভর্তি করেছি। তাদের যাতায়াতে কষ্ট হলেও সেখানে তারা ভালো পড়ালেখা করছে।
কলেজ ছাত্র সাকিব হাসান জানান, ‘শিক্ষকদের অবহেলার কারণেই আজ বিদ্যালয়টি ধ্বংসের পথে। কেন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসেন না এবং ভর্তি হতে চান না সেটা শিক্ষকেরাই ভালো জানেন। তবে বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থী শূন্য এবিষয়ে কখনো কোন শিক্ষকের মাঝে উদ্বেগ বা প্রচেষ্টা দেখতে পায়নি। এটা দুঃখজনক।
বিদ্যালয়ের পাশেই বসবাসরত হাছেন আলী বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষকরা প্রতিদিন স্কুলে আসে আর চেয়ার নিয়ে মাঠে বসে পেপার পড়ে, গল্প করে। যদিও দুই চারজন শিক্ষার্থী স্কুলে আসে। তবুও তাদের ঠিকমতো ক্লাস নেয়া হয় না। শিক্ষার্থীরা দুই এক ঘন্টা গল্প করে সময় কাটিয়ে বাড়ি চলে যায়। কখনও স্কুলে বেল/ঘন্টা বাজতেও শুনি না।
বিদ্যালয়ের জমিদাতা মৃত খুশ মাহমুদ সরকারের ছেলে সরোয়ার আলম বলেন, ’অনেক কষ্ট করে শ্রম ঘাম দিয়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু আজ শিক্ষকদের অবহেলায় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের বেহাল দশা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের পরিশ্রমটাই বৃথা। আমি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে এই জন্য দায়ী করবো। তারা কেন সবকিছুই জেনে শুনে দেখে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এছাড়া একটি শিক্ষার্থী শূন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারীরা কিভাবে বেতন ভাতা উত্তোলন করে? এটা কি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দেখে না।
বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক আবু সাঈদ বলেন, ‘বর্তমানে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে। তবে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর উপস্থিতি খুবই অপ্রতুল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পরপরই শুরু হয় শিক্ষকদের মাঝে পাঠদানে অনিহা, অনিয়ম ও অনুপস্থিতি। প্রধান শিক্ষক এসব দেখেও না দেখার ভান করে তাদের প্রশ্রয় দেন। প্রধান শিক্ষক এবং সভাপতি দায়িত্বের অবহেলার কারণেই আজ প্রতিষ্ঠানটি বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি জহুরুল ইসলাম মানিক মুঠোফোনে বলেন, ‘বিদ্যালয়ের ভালোমন্দ দেখভালের দায়িত্ব কি শুধু ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির নয়। শিক্ষকদেরও দায়িত্ব আছে। শিক্ষকরা যদি নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে না আসেন, শিক্ষার্থীদের পাঠদান না করায় সেটি দেখার দায়িত্ব প্রধান শিক্ষকের। এছাড়াও তিনি কখনোই আমাকে এ বিষয়ে অবগত করেননি। বিষয়টি আমি জানলাম এবং দেখবো।
এঘটনায় চাপারকোনো মনিজা আবুল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজমেরী বেগম বলেন, ‘আমি বিদ্যালয়ে নেই বলেই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম। তবে ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো সত্য নয়। সহকারী শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলে আসেন এবং পাঠদান করান। তবে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর উপস্থিতি খুবই কম। এটি উন্নত করার চেষ্টা চলছে।
এ-ব্যাপারে সরিষাবাড়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ওই প্রতিষ্ঠানের এমন বেহাল দশা এটি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সত্যতা পেলে ঊর্ধ্বতনের সাথে কথা বলে তাদের এমপিও বাতিল করা হবে।
এ-বিষয়ে সরিষাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, ‘বিষয়টি আমি শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে কথা বলে খতিয়ে দেখব এবং সত্যিকার অর্থেই যদি শিক্ষার্থী শূন্য হয় তাহলেই বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।