খেলাধুলা

ডাউন দ্য উইকেট : ঘুণে ধরা ক্রিকেট

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সাকিব আল হাসানের অভিভাবক, নাকি উল্টোটা? ব্যর্থ বিশ্বকাপ মিশনের পর জোরেশারে ওঠা এই প্রশ্ন শুনে বিব্রত বোর্ড কর্তারা। কিন্তু জোর গলায় যে নিজেদেরই অভিভাবক বলে দাবি করবেন, সেই অবস্থানেও তাঁরা আর নেই। বিসিবির কর্তৃত্বের কথা আইনে আছে। তবে বাস্তবতা হলো, সাকিবের পছন্দ অপছন্দই অগ্রগণ্য।

এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলে ক্রিকেটবিশ্বও। বিশ্বকাপের মাঝপথে বাংলাদেশ অধিনায়কের দেশে ফেরায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন ভিনদেশের সাবেক ক্রিকেটাররা। কিন্তু বিসিবি নীরব, কারণ সাকিবের এমন প্রশ্নবিদ্ধ একটি দেশে ফেরায় সফরসঙ্গী ছিলেন খোদ বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন! তো, সভাপতিই যখন অনুমোদন দিয়েছেন তখন আর কী করা। নাজমুল হাসানের সামনে দাঁড়িয়ে ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার লোকও বোর্ডে নেই।

কানাঘুষা আছে, পরিচালকদের ৮০ শতাংশ এবার আওয়াজ তোলার পক্ষে। কিন্তু আপাত বিপ্লবী এই সংঘের হয়ে বোর্ড সভায় আওয়াজটা কে তুলবেন, সেটি নিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি চলছে! আগুনে হাত দেবেন কে? কারণ, এমন দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে ইনিংসের প্রথম বলে ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে চালানো বরং কম ঝুঁকিপূর্ণ! অতঃপর সাকিব না বোর্ড-প্রশ্নটা থেকে যাবে। না, পুরোপুরি ঠিক হলো না। বিশ্বকাপের ঠিক আগে সরিয়ে দেওয়া টিম ম্যানেজারকে আবার ফিরিয়ে এনেছে বিসিবি।

বিশ্বকাপের আগে তৎকালীন ম্যানেজারকে বাদ দেওয়া হয়েছিল অধিনায়কের ইচ্ছায়। সেই তাঁকে ফিরিয়ে আনা মানে কি এটা প্রমাণ করা যে সাকিবের ইচ্ছার ভেলায় আর দোল খায় না বোর্ড? এই ধারণার বিপক্ষে অবশ্য পাল্টাযুক্তি আছে। নাফিস ইকবালকে ম্যানেজার পদে ফিরিয়ে আনা হয়েছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের জন্য। এই সিরিজে খেলছেন না টেস্টের নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব। তাই প্রশ্ন থাকছে, নিয়মিত অধিনায়ক ফিরলেও কি নাফিসকে দায়িত্বে বহাল রাখবে বিসিবি?

অদ্ভুত এক পরিস্থিতি দেশের ক্রিকেটে।

নয় বিষয়ের সাতটিতে ডাহা ফেল করে আসা দলের ম্যানেজার কে হলো না হলো, তা নিয়ে গুচ্ছের শব্দ ব্যয় করা হচ্ছে! সমস্যাটা এখানেই। এ যুগের টিম ম্যানেজার দলের ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্ত নন। দলের লজিস্টিকস মানে, প্র্যাকটিস সুবিধা এবং আয়োজক বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া একজন ম্যানেজারের আর কোনো কাজ নেই। সেই পদেও পছন্দ-অপছন্দের বিষয় চলে আসে নিতান্ত ক্ষুদ্রতা থেকে। মানসিক এই সংকীর্ণতা নিয়ে ভালো কিছু করা দিবাস্বপ্ন। বরং নয় ম্যাচের সাতটায় হারই মানানসই!

বিসিবির হাবেভাবে মনে হচ্ছে, দেশের ক্রিকেট প্রশাসনও এর সঙ্গে একমত। তাদের দেখে মনে হচ্ছে, বেশ আছেন। নইলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে সেই কবে, ১১ নভেম্বর। অথচ এখনো পর্যন্ত প্রধান কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহে ও অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে পাশে নিয়ে ব্যর্থতার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি বিসিবি। চোট নিয়ে দেশে ফিরে আমেরিকায় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আবার দেশে এসেছেন সাকিব। বিশ্বকাপ মিশন শেষে হাতুরাসিংহে দলের সঙ্গে ফিরেছিলেন। কয়েক দিন পর তিনিও নীরবে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, ইনিয়ে-বিনিয়ে দেরি করে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার জাতীয় হতাশা লাঘবের অপেক্ষায় ‘ওত’ পেতে বিসিবি। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ড দল টেস্ট সিরিজ খেলতে দেশে এসে পড়েছে। এখন জনতা নতুন করে মাঠের ক্রিকেটে ডুব দেবে, অতীত হয়ে যাবে বিশ্বকাপ। বিসিবি কি এমন ফন্দিই এঁটেছে?

স্ট্র্যাটেজি হিসেবে অবশ্য মন্দ নয়! তবে এভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা দেশের ক্রিকেটের জন্য অমঙ্গলজনক। শোনা যাচ্ছে, বিশ্বকাপে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে হাতুরাসিংহের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সরব হবেন বোর্ড কর্মকর্তারা। কিন্তু সভাপতির অতি প্রিয়ভাজন তিনি। তাই নাজমুলের মুখের ওপর হাতুরাসিংহকে নিয়ে কি প্রশ্ন তোলা যায়? তার চেয়ে বরং মুখ বুজে জনতার নিন্দামন্দ হজম করা নিরাপদ। আত্মপরিচয়, নিজের আত্মগরিমা-এসবে ধুলাবালি পড়েছে তো সেই কবে!

মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর কথাই ধরুন। খেলোয়াড়িজীবনে ম্যাচের পর ম্যাচ জিতিয়েছেন দলকে। অহংকার ঠিকরে বেরোত তাঁর ব্যাটে, ব্যক্তিত্বে। কাউকে বিশেষ পাত্তাটাত্তা দিতেন না। সেই তিনিও মুখ বুজে নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। মুখ বুজে বলা এ কারণে যে, মিনহাজুল দল ঘোষণার দায়িত্ব পালন করেন। দল নির্বাচনী সভাও করেন। কিন্তু চূড়ান্ত দলটা যে তাঁর, এটা কেউ বিশ্বাস করে না! এই অবিশ্বাস মিনহাজুল কিংবা হাবিবুল বাশারের মতো সাবেক তারকাদের জন্য মানহানিকর। তবু বিশ্বকাপ ব্যর্থতার প্রথম এমনকি, একমাত্র বলিও হতে পারেন তাঁরা। শোনা যাচ্ছে, পরের বোর্ড সভায় বর্তমান নির্বাচক কমিটিতে অদলবদল হতে পারে। তবে এঁরা থাকুন কিংবা নতুন কেউ আসুন-দল নির্বাচনে নির্বাচকদের ভূমিকা নিয়ে সংশয় থাকবেই। এমন একটি আবহ কেন ছড়িয়ে পড়েছে, এই প্রশ্নের উত্তর বিসিবির খোঁজা জরুরি।

এই দল গড়ার রহস্য তবু আন্দাজ করা যায়। কিন্তু বিশ্বকাপের মাস দুয়েক আগে থেকে হাতুরাসিংহের কাণ্ডকীর্তির রহস্য ভেদ করা কঠিন। বিশ্বকাপের ঠিক আগে, এশিয়া কাপে বিশ্বকাপের একাদশ খুঁজতে গিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন হাতুরাসিংহে। ধারণা করা হয়েছিল, বিশ্বকাপে এমন কিছু হবে না। কিন্তু হলো তার চেয়েও বেশি কিছু। এক ওপেনিং জুটি ছাড়া কে কখন নেমে পড়েন-এই একটা কৌতূহল বিশ্বকাপের শহর থেকে শহরে বয়ে বেড়িয়েছেন হাতুরাসিংহে। বিসিবি সভাপতিও নাকি বিস্মিত এই ওলটপালট দেখে। এদিকে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে ব্যাখ্যাতীত গবেষণায় ক্রিকেট জুয়াড়িরা কলকাঠি নেড়েছে কি না, এমন সন্দেহও রটে গেছে।

আমরা, সংবাদকর্মীরা বিস্মিত হয়েছি বিশ্বকাপজুড়ে নাজমুল হাসানের অভাবনীয় নীরবতায়। এমনি দিনেও খবরের লোকেরা তাঁর পিছু নেয়, খবরের খোরাক দেনও বোর্ড সভাপতি। কিন্তু ২০২৩ বিশ্বকাপের জ্বালামুখ খুলে যাওয়ার পরও নীরব বিসিবি সভাপতি! কোথায় যেন সেদিন পড়লাম, তিনি তৈরি হচ্ছেন যাবতীয় ব্যাখ্যা নিয়ে। ধারণা করা যায়, সেসব ব্যাখ্যার উৎসমুখ হাতুরাসিংহে। প্রথম মেয়াদের পর দ্বিতীয় মেয়াদে আরো কুশলী তথাকথিত ‘কড়া হেডমাস্টার’। আড়ালে বোর্ড সভাপতিকে টেকনিক্যাল ব্যাখ্যার জালে আটকে ফেলা হাতুরাসিংহে এবার সাকিবকেও নাড়াচাড়া করছেন না। এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের মাঝপথে সাকিবের ছুটি অনুমোদন করেছেন তিনিই। এই পরিবর্তন দেখে সাকিবও নিশ্চয়ই আড়ালে মুচকি হাসেন!

কৌতূহল জাগিয়েছেন খালেদ মাহমুদ সুজনও। মুম্বাই থেকে সাকিব ছুটিতে দেশে যাওয়ার খবরে টিম ডিরেক্টরের মন্তব্য ছিল খুবই ইতিবাচক। নিজের ক্রিকেট নিয়ে চিন্তিত বলেই সাকিব দেশে গেছেন নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছে ব্যাটিংয়ের তালিম নিতে-এমন একটি ধারণা দিয়েছিলেন টিম ডিরেক্টর। কিন্তু পরদিন জল ঘোলা হতেই ‘স্ট্যান্স’ বদলে ফেলেন মাহমুদ। ‘এ্যাই, ছুটি কে দিল রে’, বলে বোর্ডের তোলা স্লোগানে মিশে যান তিনিও। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, টিম ডিরেক্টরের কার্যপরিধি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে করা তাঁর মন্তব্য। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল যাওয়ার বেশ আগেই নির্ধারিত ছিল যে এবারের টিম ডিরেক্টর ম্যাচ পরিকল্পনার অংশ হবেন না। এই কার্যপরিধি মাহমুদকে জানানো হয়নি, এমন স্বীকারোক্তি বোর্ডের কোনো মহল থেকে শোনা যায়নি। তা ছাড়া কার্যপরিধি না জেনেই কেউ প্লেনে চড়ে বসবেন, এটা হয় নাকি! কিন্তু দল রসাতলে যাওয়ার পর সংবাদমাধ্যমকে মাহমুদ জানিয়েছেন যে, কর্তৃত্ব খর্বের খবরটি আগে জানলে তিনি দলের সঙ্গে আসতেন না। অবশ্য পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছিল, তাতে আগে জানলে হয়তো আরো কেউ কেউ বিশ্বকাপের ধারেকাছেও যেতেন না!

এগুলো কথার কথা। ক্রিকেট বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম খেলা। সাফল্যও আছে। সেসব তো আর একটা বিশ্বকাপ ব্যর্থতায় ধুলায় মিশে যাবে না। আইসিসি সুপার লিগের তিন নম্বর দল হয়ে বিশ্বকাপে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। টেস্টে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। মাঝখানে শুধু বিশ্বকাপটা খারাপ গেছে, এই তো!

সেদিন বন্ধুদের আড্ডায় এই রসিকতা করেও পার পাইনি। একজন নতুন করে পুরনো অভিযোগ নিয়ে প্রায় তেড়ে এলো, ‘তোরা (সংবাদমাধ্যম) (ক্রিকেটারদের) মাথায় তুলে রাখিস বলেই আজ এই অবস্থা!’ অথচ এর দুই দিন আগে নেতিবাচক খবর না করার পরামর্শ শুনতে হয়েছে বিসিবির মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে।

এখন আমরা যাব কোথায়? এই আমরা বলতে ক্রিকেটার, ক্রিকেটের অভিভাবক, অনুসারী এবং সংবাদকর্মীরা। যাওয়ার জায়গা নেই। পুরো সিস্টেমটাই ঘুণে খেয়ে ফেলেছে।

চলমান সিস্টেম একমুখী-জাতীয় দলভিত্তিক চিন্তায় মগ্ন সবাই। এই পদ্ধতি ক্রিকেটের সামগ্রিক উন্নতির পরিবর্তে ক্লাবমুখী, ক্লাবের সিঁড়ি বেয়েই তো বোর্ডে ঢুকতে হয়। এই পদ্ধতি ব্যক্তি তোষণের। বোর্ড সম্মিলিতভাবে কোন কোন ব্যক্তির কাছে বশীভূত, সেসব বারবার বলা নিরর্থক।

তবে ক্রিকেট দলে সবচেয়ে আগে অধিনায়কের এবং এরপর কোচের কর্তৃত্ব থাকা অত্যাবশ্যক। তবে সেটির অপচয় কিংবা অপব্যবহার হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করবে বোর্ড। উন্নতির এই প্রাথমিক শর্তই অনুপস্থিত বিসিবিতে। এরপর আর কী বলার থাকতে পারে।

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker