মাহফুজ হাসান, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়িটিও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।দেশে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে বহু আগেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জমিদারদের বাসস্থানগুলো। তার মধ্যে গাঙ্গাটিয়া একটি।
এ জমিদার বাড়িতে জমিদারের ছেলে মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী (মানব বাবু) এখনো বসবাস করছেন। তিনিই বাড়িটি দেখভাল করেন এবং স্থানটি দৃষ্টিনন্দন করে রাখছেন। মানব বাবু এ বাড়িতে রয়েছেন বলেই বাড়িটি এখনো মানব বাবুর বাড়ি হিসেবেই এলাকায় বেশ পরিচিত। যা দেখতে প্রতিনিয়ত দূর-দূরান্ত থেকে দেশি বিদেশি পর্যটকরা ছুটে আসেন।
গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়িটির গোড়াপত্তন শুরু হয় বৃটিশ শাসনামলের শুরুর দিকে। এই জমিদার বাড়িটির প্রতিষ্ঠাতা ভোলানাথ চক্রবর্তী। অন্যান্য জমিদার বাড়ির মতো এটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত না হয়ে, এখনো এটি পুরোপুরি টিকে আছে স্থাপত্যের এক নিদর্শন হিসেবে।
জমিদার বাড়ির ভেতরের অট্টালিকা চমৎকার কারুকাজ ও নৈপুণ্যে ভরা। তবে বাইরের অংশ জরাজীর্ণ। জমিদার বাড়ির নহবতখানা, দরবারগৃহ ও একটি মন্দির বিশেষ স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
এই জমিদার বংশের আদি বসবাস ছিল ভারতের কাইন্নকব্জিতে। প্রায় শত বছর আগে তারা সেখান থেকে হোসেনপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এ পরিবারের দীননাথ চক্রবর্তী হোসেনশাহী পরগনার অংশ বিশেষ নীলকর ওয়াইজের কাছ থেকে ক্রয় করে এ পরিবারের প্রথম জমিদারি প্রথার সূচনা করেন। এর কিছুকাল পর অতুলচন্দ্র চক্রবর্তী ‘পত্তনি’ সূত্রে আঠারো বাড়ির জমিদার জ্ঞানদা সুন্দরী চৌধুরাণীর কাছ থেকে দুই আনা-অংশ গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ির অন্তর্ভুক্ত করেন। বৃটিশ শাসনামলের শুরু থেকেই তাদের জমিদারিত্ব শুরু হয় এবং দেশ ভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে তাদের জমিদারিও শেষ হয়।
বর্তমান জমিদার বাড়ি থেকে দক্ষিণে প্রথম তাদের বসতবাড়ি তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে সেই বাড়ির পতিত ভিটায় গৌড়ীয় রীতির তৈরি একটি প্রাচীন শিবমন্দির রয়েছে। এ শিবমন্দিরটিই এ বংশের প্রতিষ্ঠিতদের নির্মিত প্রথম মন্দির। এ ছাড়াও বাড়ির সামনে রয়েছে সুবিশাল পুকুর। ব্রাহ্মণ্য ধ্যান-ধারণা, পূজা-পার্বণ, আচার অনুষ্ঠান পালনে এ অঞ্চলে এক সময় বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল।
ইংরেজ আমলেও পরিবারটি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য সাধনায় বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল। সাহিত্যিক গবেষক এবং হাইকোর্টের জজ দারনাথ চক্রবর্তী এ পরিবারেরই লোক ছিলেন। এলাকায় তারা মানব দরদি হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এই বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। আর এ খবর জানতে পেরে এদেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই জমিদার বাড়িতে হামলা চালায়। মানবেন্দ্র চক্রবর্তীর বাবা ভূপতি চক্রবর্তীসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের তারা নির্মমভাবে হত্যা করেন। বর্তমানে পাকিস্তানি বাহিনী যে জায়গায় ভূপতি চক্রবর্তীকে হত্যা করা হয়েছে সেখানে একটি সমাধি তৈরি করা হয়েছে।
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর অনেকদিন ধরে কোনো সংস্কার না করার কারণে জমিদার বাড়িটি কিছু কিছু অংশ ভেঙে যায়। পরবর্তীতে বর্তমান জমিদার বংশধর মানবেন্দ্র চক্রবর্তী জমিদার বাড়িটি সংস্কার করে নতুনত্ব করে তোলেন।
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts sent to your email.