ইতিহাস ও ঐতিহ্য

কাঁধের পালকি স্থান হয়েছে জাদুঘরে

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এক প্রাচীন বাহন ছিল পালকি। মানুষ বহন করার কাজেই এ পালকি ব্যবহার হতো। এটি বিলাসিতা বাহন হিসেবেই পরিচিতি ছিল। প্রাচীনকালে সাধারণত ধনী গোষ্ঠী এবং সম্ভ্রান্ত বংশের লোকেরা এর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন। পালকি চাকা বিহীন এক বাহন। সাধারণত পালকিকে ২ থেকে ৮ জন ঘাড়ে ঝুলিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যারা পালকি কে ঘাড়ে বা, কাঁধে করে বহন করে থাকেন তাদের পালকির বেহারা বা, কাহার বলে। পালকির ভেতরে ১ জন বা, ২ জন থাকত।

ধারণা করা হয় প্রাচীনকালে দেব-দেবদেবী আরোহণ বা, দেব-দেবীর মূর্তি বহনের জন্য পালকি সদৃশ বাহন ব্যবহার করা হতো। অনেক প্রাচীন মন্দিরেই পালকি দিয়ে দেবতাদের বহনের দৃশ্য ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। সম্রাট আকবরের শাসন আমলে এবং তারও পরবর্তী সময়ে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের জন্য প্রধান বাহন হিসেবে পালকিই ব্যবহৃত হতো।

বাংলাদেশে এক সময় অভিজাত শ্রেণীর এই বাহনে চলাচল করতো। দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে ও এর ভালোই প্রচলন ছিল। বিয়েতে বর এবং বধূর জন্য পালকি ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল। এছাড়াও অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে বা অক্ষম মানুষকে বিভিন্ন স্থানে নেয়ার জন্যও পালকি ব্যবহার হতো। এমন এক সময় ছিল, বিয়ে মানেই পালকি। পালকি ছাড়া বিয়ের বিয়ের আনন্দ পরিপূর্ণ হতো না। বেহারারা পালকি বহন করার সময় নির্দিষ্ট ছন্দে পা ফেলে চলত। পালকি বহনের সময় তারা বিশেষ ছন্দে গানও গাইত। তাদের চলার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গানের তাল-লয় পরিবর্তিত হত। পালকির কাহাররা বর বা বধূর বাড়িতে যেয়ে বিভিন্ন লয়ে বিভিন্ন ধরনের গান ধরত এবং ডাকতে থাকতো তাদের আত্মীয় স্বজনদেরকে, যত যতক্ষন পর্যন্ত ওইসব আত্মীয়-স্বজন তাদের কিছু টাকা পয়সা না দিত, থামত না। কাহারদের এ ধরনের আচরণে কেউ কোনোদিন বিরক্তিবোধ করতো না বরং আনন্দ পেত, কেননা এটা ছিল বিয়ের একটি আনন্দের অংশ।

কাঠ মিস্ত্রীরা সেগুন, শিমুল প্রভৃতি কাঠ দিয়ে তৈরি করতো পালকি। পালকির বহন করার দণ্ডটিকে বাঁট বলে। এই বাঁট তৈরি হত বট গাছের বড় ঝুরি দিয়ে। তখন বাংলাদেশে তিন রকমের পালকি দেখা যেত। সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খি পালকি। সাধারণ পালকি দেখতে আয়তাকার ছিল। ঢালু ছাদ এবং চারদিকে কাঠের আবরণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এর দু দিকে দুটি দরজাও থাকতো।

আয়না পালকির বৈশিষ্ট্য হলো এতে আয়না লাগানো থাকতো। ভেতরে চেয়ারের মতো দুটি বসার জায়গা এবং একটি টেবিলে রাখা হতো। তবে আয়তনের দিক থেকে বলতে গেলে ময়ূরপঙ্খি পালকি সবচেয়ে বড়। এই পালকিটি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়। এর ভেতরে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল এবং একটি তাকও থাকতো।

বর্তমানে পালকিকে আমাদের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই ধরা হয়। সে যুগের পালকি ছিল এ যুগের মোটরগাড়ির অনুরূপ। বেহারাদের কাঁধ থেকে পালকির স্থান এখন হয়েছে জাদুঘরে।

Author


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

দ্বারা
শহীদুল ইসলাম শরীফ,

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker