অর্থনীতিবাণিজ্যবিবিধব্যাংক ও বিমাসারাদেশ

ব্যাংকে ভোক্তা ঋণের সুদ সাড়ে ১৩%

চলতি বছরের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে বড় অঙ্কের ঋণের সুদহার হবে ১২.৪৩ শতাংশ। তবে ভোক্তা ঋণের সুদহার পড়বে প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে এই বড় অঙ্কের ঋণের সুদহার ছিল ১১.৮৯ শতাংশ আর ভোক্তা ঋণের সুদহার ছিল ১২.৮৯ শতাংশ।

ধারাবাহিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে সুদহার।

যদিও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপে আছে সাধারণ মানুষ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার সরবরাহ কমাতে এ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত জুলাই মাস থেকে ঋণের সুদহারের সীমা ৯ শতাংশ তুলে নেওয়ার পর চড়া সুদ গুনতে হচ্ছে। এখন যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, তা হলো ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ তথা-সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল।

প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সুদহারের নতুন যুগে প্রবেশের আগে ৯ শতাংশ ছিল। ২০২০ সালের এপ্রিলের আগে সুদহার ছিল পুরোপুরি মুক্ত। তখন ব্যাংক ঋণের সুদ ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল।সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঋণের সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। এ জন্য চাহিদা ও সরবরাহ দুই দিক থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এই সুদহার বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব পড়বে। একদিকে ভোক্তা ঋণে ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে বিনিয়োগ কমবে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হবে।

ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অভিঘাত পড়বে। এ কারণে জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। তাই সার্বিক পরিস্থিতি ঠিক রাখতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। 

গত জুলাইয়ে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদহার (স্মার্ট রেট) ছিল ৭.১০ শতাংশ, আগস্টে ৭.১৪ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয় ৭.২০ শতাংশ, অক্টোবরে ৭.৪৩ শতাংশ, নভেম্বরে ৭.৭২ শতাংশ, ডিসেম্বরে ৮.১৪ শতাংশ এবং সব শেষ জানুয়ারিতে স্মার্ট রেট বেড়ে দাঁড়ায় ৮.৬৮ শতাংশে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসের ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে এখন সর্বোচ্চ ৩.৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে ৫.৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন যোগ করতে পারে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অবশ্য একবার সুদহার কার্যকর করা হলে পরবর্তী ছয় মাসে তা আর পরিবর্তন করা যায় না।জানুয়ারি মাসের ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩.৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক। সেই হিসাবে ২০২৪ সালের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে বড় অঙ্কের ঋণে সর্বোচ্চ ১২.৪৩ শতাংশ সুদ নিতে পারবে।প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ও কৃষি ও পল্লী ঋণের ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২.৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন যোগ হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণ এবং কৃষি ও পল্লী ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১.৪৩ শতাংশ। যা জানুয়ারিতে ছিল ১০.৮৯ শতাংশ।তবে ফেব্রুয়ারিতে ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে ব্যাংক সুদ নিতে পারবে ১৩.৪৩ শতাংশ। কারণ সিএমএসএমই, ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে অতিরিক্ত ১ শতাংশ তদারকি বা সুপারভিশন চার্জ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে, যা জানুয়ারিতে ছিল ১২.৮৯ শতাংশ। সাধারণত ব্যাংক থেকে ব্যক্তিগত ও ভোগ্য পণ্য যেমন গাড়ি কেনার ঋণ, আবাসন ঋণ, শিক্ষা ঋণসহ ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার ইত্যাদি ক্রয় করার জন্য যে ঋণ নেওয়া হয়, এগুলো ভোক্তা ঋণ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহারব্যাংকের ক্ষেত্রে শুধু ঋণে সর্বোচ্চ সীমা থাকলেও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত সংগ্রহেও সুদহারের একটা সর্বোচ্চ সীমা দেওয়া আছে। এসব প্রতিষ্ঠান স্মার্টের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২.৭৫ শতাংশ সুদ যোগ করে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে। ‘স্মার্ট’ রেটের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫.৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে ঋণের বিপরীতে সুদ নিতে পারবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এনবিএফআই। সেই হিসাবে ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের সর্বোচ্চ ঋণের সুদহার হবে ১৪.৪৩ শতাংশ এবং আমানতে ১১.৪৩ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ছিল ১৩.৮৯ শতাংশ এবং আমানতে ১০.৮৯ শতাংশ। তবে ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও ফেব্রুয়ারিতে ঠিক করা ঋণের এই সুদহার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তন করা যাবে না।বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদহার প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, গত জানুয়ারিতে স্মার্ট ছিল ৬.৯৬ শতাংশ। এরপর প্রতি মাসে একটু করে বেড়ে গত মে মাসে দাঁড়ায় ৭.১৩ শতাংশ। জুন ও জুলাইয়ে সামান্য কমে ৭.১০ শতাংশে নামে। এরপর আগস্ট থেকে ধারাবাহিক সুদহার বাড়ছে।আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে নব্বই দশক থেকে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা আরোপ করা হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে বিভিন্ন পর্যায় থেকে সীমা তুলে নেওয়ার জন্য বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও সুদহারের সীমা প্রত্যাহার অথবা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সরকারের ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় নীরব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হলো, সুদহার বাজারভিত্তিক করা। সেই শর্তের আলোকে নতুন ব্যবস্থা চালু করা হয়।মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে তারা। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হবে।কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের সুদের হার আরো বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো যাতে কোনো ধরনের সমস্যায় না পড়ে, সে বিষয়ে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯.৫৮ শতাংশ। নভেম্বরে এই মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৭৬ শতাংশ। গত অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৬ শতাংশ, যা ছিল বিগত প্রায় ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker