ব্যাবসায়িক বিনিয়োগে বাধা, দেশের ঋণমানের অবনতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বিদেশি ঋণে। পর্যায়ক্রমে ১১.০৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ। কিন্তু দেড় বছর আগেও এই ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ঋণমান কমিয়ে দেওয়ার কারণে বিদেশি উৎস থেকে আগের তুলনায় কম ঋণ পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সুদহার বাড়ানোর প্রভাবও আছে বিদেশি ঋণের ওপর।
গত ২৭ মে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান দ্বিতীয়বারের মতো কমিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক ঋণমাণ নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান ফিচ রেটিংস ইনকরপোরেশন। বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) ‘বিবি মাইনাস’ থেকে ‘বি প্লাস’ করেছে সংস্থাটি। আট মাস আগেও বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছিল তারা।
এর আগে ২০২৩ সালের মার্চে আরেক আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির মতে, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে চলমান সংকটের মধ্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে মুডিস বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়ে দেয়।
আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিশাল প্রভাব পড়েছে নতুন বিনিয়োগে। ব্যবসায়ীরা এখন নতুন বিনিয়োগে ভয় পাচ্ছেন। পাশাপাশি রেটিং এজেন্সির নেতিবাচক রেটিংয়ের কারণে ঋণদাতাদের আস্থা কমেছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, দেড় বছর ধরে ডলারের দাম বাড়ার কারণে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের পরিমাণ কম ছিল। এ ছাড়া দেশের ব্যবসায়ীরা এখন ব্যবসা বাড়াতে পারছেন না।
এমনকি আগের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারছেন না অনেকে। তাই ঋণের প্রয়োজন হচ্ছে না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে দেশের ঋণমান কমে যাওয়ার প্রভাবও কিছুটা রয়েছে। এই জায়গা থেকে উত্তরণে ব্যাবসায়িক পরিবেশ স্বাভাবিক হওয়া খুব জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, প্রথম কথা হলো, ব্যবসায়ীদের এখন আর ঋণের প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ নীতি সহায়তার অভাবে তাঁরা নতুন বিনিয়োগ করছেন না এবং ব্যবসাও বাড়াচ্ছেন না। ক্রমেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য একটি অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নেতিবাচক মার্কিং। পদে পদে দুর্নীতি, পদে পদে ঘুষ, পাশাপাশি ব্যবসা করতে গেলে এখন নানা সংকট। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রীতিমতো হয়রানি করছে ব্যবসায়ীদের, যার ফলে দেশে ব্যবসার পরিবেশ নেই। এসব কারণে বিদেশি সংস্থাগুলো ঋণমাণ কমাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিদেশি ঋণদাতারা ঋণ দিলে সেই ঋণ ফেরত পাবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান। তারা আমাদের দেশের ওপর আস্থা পাচ্ছে না। এ কারণেই স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমছে।
একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমাদের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ কমার অন্যতম কারণ আমদানি অনেক কমে যাওয়া। এতে বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বায়ার্স ক্রেডিট কম হওয়ায় বৈদেশিক ঋণ কমেছে। বৈশ্বিক ঋণমান নির্ধারণকারী সংস্থাগুলো দেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণমান অবনমন করায় বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ক্রেডিট লাইন সীমা কমেছে। এটাও অন্যতম কারণ।’
তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময় আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার সর্বনিম্নে নেমেছিল। এ কারণে ব্যবসায়ীরা দেশের ব্যাংকের তুলনায় বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। এখন বিশ্ববাজারে সুদের হার চড়া। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সুদের হার কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। এ কারণে বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপ-আমেরিকায় বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, বিদেশি ঋণ কমার অন্যতম কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেড়ে যাওয়া। করোনা মহামারির সময় দেশের অনেক বিদেশি ঋণ ও এলসি দায় নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। অনেক প্রতিষ্ঠান নিজে থেকেই ঋণ নবায়ন করে দিয়েছিল। এখন মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পরিশোধে চাপ দিচ্ছে। নবায়নে রাজি না হলে ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা সে ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের মে মাস শেষে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ১১.০৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সাল শেষে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬.৪১ বিলিয়ন। অর্থাৎ দেড় বছরের ব্যবধানে ৫.৩৭ বিলিয়ন ডলার স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমেছে।
বিদেশি উৎস থেকে দেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদের জন্য তহবিল ঋণ নেওয়াকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ হিসেবে ধরা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য আমদানিকারকরা বিদেশি ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ নেন, যা বায়ার্স ক্রেডিট নামেও পরিচিত। মে মাস শেষে বায়ার্স ক্রেডিট দাঁড়িয়েছে ৫.৬৮ শতাংশ। স্বল্পমেয়াদি আমদানি দায় পরিশোধেও ব্যাংকগুলো বিদেশি উৎস থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে থাকে। বিদেশি ঋণের উপখাত স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ২.৮৮ বিলিয়ন, ব্যাক টু ব্যাক এলসি এক বিলিয়ন এবং ডেফারড পেমেন্ট (বিলম্বে মূল্য পরিশোধ) ৭৬৮ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতে মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯.৩০ বিলিয়ন ডলার। এর আগে, গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণ ১০০.৬৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ প্রকাশিত ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি’র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গেল অর্থবছরের চেয়ে তা চার হাজার ৭০০ কোটি টাকা বেশি। গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুসারে, বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ সরকারের মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ বাবদ ৯ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। অর্থাৎ চার বছরের মধ্যে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল বাবদ ২৬২ কোটি ৯০ লাখ ডলার বা ৩০ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বাবদ ২৪৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার পরিশোধ করার কথা রয়েছে, যা টাকায় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৯৮১ কোটি। অর্থাৎ এক বছরে বিদেশি ঋণের আসল বাবদ পরিশোধ বাড়ছে ১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার।
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts sent to your email.