ইতিহাস ও ঐতিহ্য

বিলুপ্ত পথে প্রায় বেত গাছ

লতাপাতা আর সবুজ শ্যামলে ভরপুর ছিল গ্রামবাংলার পথঘাট প্রান্তর আর লোকালয়। বিভিন্ন ঋতুতে নানান রংঙ্গে সাজতো গ্রাম বাংলার প্রকৃতি।

আগে গ্রাম বাংলায় অনেক দেশী গাছ গাছালী পাওয়া যেত। এখন অনেক গাছ গাছালী বিলুপ্তির পথে। এ রকম একটি বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি হচ্ছে বেত গাছ। আগের মত গ্রাম-গঞ্জে বেত গাছ তেমনটা দেখা যায় না।

বেত গাছ সাধারণত গ্রাম-গঞ্জে রাস্তার পাশে, বসতভিটার পিছনে, পতিত জমিতে ও বন-জঙ্গলে কিছুটা আর্দ্র জায়গায় জন্মে। খুব অল্পদিনের মধ্যেই বেত গাছ ঘন ঝাড়ে পরিণত হয়।

চির সবুজ এই উদ্ভিদটি পূণবয়স্ক অবস্থায় ৪৫ থেকে ৫৫ ফুট এবং কখনো কখনো তার চেয়ে বেশী লম্বা হয়ে থাকে। বেত গাছে ফুল ধরার আগের গাছ থেকে এক ধরনের মিষ্টি ঘ্রাণ আসে। তখন পিঁপড়া, মৌমাছি, ভিমরুল  এই রস খেতে বেত গাছে ভিড় জমায়।

বেত গাছের ফলকে বেতফল, বেওুন, বেথুন, বেথুল, বেতগুটি, বেওুইন ইত্যাদি নামে ডাকা হয় অঞ্চল ভেদে। এই উদ্ভিদ ত্রুান্তীয় ও উপত্রুান্তীয় অঞ্চলে ভেজা ও জংলা নিচু ভূমিতে ভাল জম্মে। বেত গাছ চিকন ও লম্বাটে হয়ে থাকে। বেত গাছ কাঁটাযুক্ত ও শক্ত হয়ে থাকে। বনজঙ্গলে কাঁটা ও ঝোঁপ আকারে জন্মে।

এক গাছের সাথে অন্য গাছ প্রায় সংযুক্ত অবস্থায় থাকে। একটি গাছ ধরে টান দিলে প্রায় সব গাছ নড়ে ওঠে। চৈত্র মাসে আঙ্গুলের মত থোকায় থোকায় ধরে।

বাংলাদেশের একটি বিলুপ্ত প্রায় ফল। ২-৩ দশক আগেও আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জের বনজঙ্গলে ও নিচু ডোবার ধারে বেত গাছ দেখা যেত। বেত ফল গোলাকার বা একটু লম্বাটে গোলাকার আশেঁ ঢাকা ছোট ও কষযুক্ত টক-মিষ্টি ফল। বীজ অত্যন্ত শক্ত হয়ে থাকে। কাচা ফল সবুজ বর্ণের, পাকলে সবুজাভ ঘিয়ে অথবা সাদা রং এর হয়ে থাকে। এর প্রতিটি থোকায় ২০০টি পর্যন্ত ফল হয়। ফল পাকে মার্চ-এপ্রিল মাসে। ইহা অপ্রচলিত ফল হলেও অনেকের কাছে খুবই প্রিয়। এটি বর্তমানে আবাসন সংকটের কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে।

আগের মত বেতুন বা বেত ফল অার চোখে পড়ে না। বাংলাদেশে প্রায় এক বিপন্ন উদ্ভিদ ও ফল। বেত গাছ এখন দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে। 

শুকনো বেত দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প জাতীয় জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। বেত দিয়ে তৈরি হস্তশিল্পগুলো হলো, চেয়ার টেবিল, মোড়া, ডালা, কুলা, চাঙ্গাড়ি, ঢুষি, হাতপাখা, চাইলোন, টোকা, গোলা, ডোলা, টোপা, চাঁচ, ধামা, বই রাখার তাক, সোফা, দোলনা ও ফুলদানিসহ নানা কাজে এর কদর রয়েছে।

বেত গাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। এগুলো দৃষ্টিনন্দন, টেকসই, মূল্যবান, নান্দনিক এবং প্রাকৃতিক।

বেত একটি মূল্যবান টেকসই ও সকল শ্রেণীর দ্রাব্য। জীব বৈচিত্র্য রক্ষাথে এটি অধিক পরিমানে রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণে যন্তবান হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশে মাটির গুনে এখানে হাজারো তরুলতার সমাহার। নদীবাহিত পলি, বৃষ্টিপাত আমাদের দেশকে দিয়েছে এক উর্বর ভূমি।

দেশে রয়েছে ৫ হাজারের বেশী প্রজাতির বন্য গাছপালা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে অনেক বন্য গাছ এখন বিলুপ্তির পথে আবার অনেক বিদেশি গাছের অগ্রাসনেও হারিয়ে যেতে বসেছে বুনো এ প্রজাতি।

আমাদের নিজস্ব গাছ পালা নিয়ে তেমন গবেষণা হচ্ছে না। আবার বিদেশী ফলের গাছ, কাঠের গাছ ও ফুলের গাছ রোপণ এবং চাষের জন্য গ্রামবাংলার  মেঠোপথ ও প্রাকৃতিক বন ব্যবহার করা হচ্ছে।

অনেকে বিদেশি ফল চাষাবাদে মানুষকে অনুপ্রেরণা দেওয়া হচ্ছে। এতে করে দেশি গাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের কবিরাজ, অদিবাসীরা ও গ্রাম বাংলার লোকজন এখনো নানা ঔষধ এবং ফলের জন্য দেশীয় গাছ পালার ওপরই নির্ভরশীল।

সকল কবিই দেশের প্রকৃতি ও গাছ পালার জয়গান করেছেন। বেতফল ছোটবেলার এক অতি কাঙ্ক্ষিত ফল। বেত ফল পরিপক্ক হলেই বেত ঝাড়ে হানা দিত গ্রামের দুরন্ত ছেলে ও মেয়ের দল। কাটাঁর আঘাত সহ‍্য করে বেত ফল নিয়ে আসতো।

ফলের বাইরের খোসা ফেলে যখন রসালো অংশটা হাতে আসতো, তখন কিশোর ও কিশোরীরা সবার সাথে মহা আনন্দো ভাগাভাগি করে খেত।

গ্রামবাংলায় বেতের কচি পাতা তরকারি হিসাবে খাওয়া হয়। বেত ফল লবন ও মরিচ দিয়ে ভর্তা করে খেতেও খুব মজার। বর্তমান প্রজন্মের ছেলে ও মেয়েদের অনেকেই জানে না বেত ফল কি?

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker