মাহফুজ হাসান, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি
প্রযুক্তির উৎকর্ষে আধুনিক যন্ত্রপাতির ছোঁয়ায় মানুষের জীবন-যাত্রা বদলে যাচ্ছে। সেই সাথে কিশোরগঞ্জে কালের আবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য যাঁতা। কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে এক সময় দেখা যেত যাঁতা। বিয়ের সময় অনেক নব বধূ বাবার বাড়ী হতে উপহার হিসেবে পেত এই যাঁতা।
একযুগ আগেও গ্রামের গৃহবধূরা যাতা দিয়ে চাল ও গম থেকে চালের গুঁড়া ও আটা-ময়দা তৈরি করতো। এছাড়া যাঁতা দিয়ে ভাঙানো হতো মুসুরি, খেসারি, মাশকলাইসহ প্রভৃতি রকমের ডাল।
পুরোনো ঐতিহ্যের যাঁতাকল এখন নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা-অজানা। আধুনিক মেশিন আবিষ্কার হওয়ায় সময় সাশ্রয় ও বিনা পরিশ্রমে মসলা জাতীয় পণ্য ভাঙানো যায় বলে যাঁতা কল ঘর থেকে বিদায় নিয়েছে বলা যায়।
জানা যায়, পাথরের তৈরি যাঁতা খুবই মসৃণ দুই খণ্ড পাথর কেটে গোল করে তৈরি করা হতো। সেই খণ্ড দুটির ভেতরের ভাগকে লোহার তৈরি বিশেষ বাটাল বা যন্ত্র দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চটলা করে এর ধার বাড়ানো হয়। যাঁতার উপরের এবং নিচের অংশের মাঝ বরাবর একটি ছিদ্র করা হয়। সেই ছিদ্রের মাঝে কাঠ বা বাঁশ দ্বারা তৈরি একটি হাতল লাগানো হয়; যা দুই পাটকে এক জায়গায় রাখতে সাহায্য করে।
দুই ছিদ্রের মাঝে বিশেষ খাঁজ কাটা দ- থাকে যার সাহায্যে পাট দুটির মাঝে কতটুকু ফাঁক থাকবে তা নির্ধারণ করা হয়। শুধু উপরের পাটে আর একটি ছিদ্র করা হয় যা দিয়ে শস্যকে ভিতরে পাঠানো হয় পিষার জন্য।
গৃহবধূরা মাঝের ছিদ্র হাতল ধরে আরেকটি ছিদ্র দিয়ে শস্য ভিতরে দিয়ে হাতল ধরে জোরে ঘুরাতে থাকে। এতে শুধু উপরের পাট নিচের পাটের উপর ঘুরতে থাকে এবং দুই পাটের ঘর্ষণের ফলে উপর হতে দেওয়া শস্য ভেঙে গুঁড়া হয়ে দুই পাটের চার পাশের ফাঁক দিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসে। যাতা পাথরের তৈরি হওয়ায় কাজ চলা কালে যাতা থেকে এক ধরনের মিষ্টি শব্দ শোনা যেতো। কিন্তু বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের কোথাও যাতার ব্যবহার তেমন চোখে পড়ে না।
এখনো কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের অনেক পরিবার যাঁতাকে ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রাখতে চেষ্টা করছেন। জেলার হোসেনপুর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: জেমস, নিকলী উপজেলার আব্দুর রহিম, তাড়াইল উপজেলার মামুদুর মামুন, মিঠামইনের শফিকুল ইসলাম এর বাড়িতে যাঁতাকল দেখতে পাওয়া যায়। যদিও তা আর ব্যবহার হয় না। হয়ত আর কিছু দিন পর এ যাঁতা কালের আবর্তনে হারিয়ে যাবে।
যাঁতাতে পিষা আটা দিয়ে বানানো পিঠা ও পায়রা পিষা ছাতু বেশ সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর বলে বয়স্ক মানুষের কাছে বেশ প্রিয়। প্রতিদিন বিকালে ও কাকডাকা ভোরে যাঁতার ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দে গাও-গ্রাম মূখরিত হয়ে উঠতো। যাঁতা ব্যবহারে যে চাল ডাল ভাঙা হতো তা অনেক পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত ।
পাড়া গায়ে ঢুকলেই ঘর ও বারান্দার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতো যাঁতা ঘুড়ানোর শব্দ। সেই সব শব্দ আজ আর শোনা যায় না। আগের নববধুরা স্বামীর ঘরে এসেই শাশুড়ীর কথায় গম-পায়রা ও ডাল পিষার জন্য যাঁতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। নববধুরা এখন আর সেই যাঁতা চোখে দেখে না। তবে গ্রাম অঞ্চলে এখনও একটি প্রবাদ বাক্য মানুষের মূখে রয়েছে যাঁতার ছাতু খেতে খুব মধু।
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts sent to your email.