চোরাপথে ভারত থেকে আসা চিনিতে সয়লাব দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ। এসব চিনি বিভিন্ন কম্পানির নামে প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে দেশে গত বছরের তুলনায় এবার ৮.১১ শতাংশ চিনি কম আমদানি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভারতে চিনির দাম দেশের তুলনায় কম হওয়ায় সেখান থেকে পণ্যটি চোরাপথে আসছে।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে বর্তমানে চিনির কেজি মানভেদে প্রতি কেজি ১১০-১৩০ টাকা। আর খুচরা বাজারে সেটা ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ভারতে একই চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭০-৭৭ টাকায়। চোরাপথে আসা চিনির মাত্র ১ শতাংশ ধরা পড়ছে।
বাকি চিনি বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি বিপাকে পড়ছে দেশি কম্পানিগুলো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে চলতি বছরের (২০২৩-২৪) জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চিনি আমদানি হয়েছে ১৩ লাখ ৩৬ হাজার টন। অথচ একই সময়ে এর আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) চিনি আমদানি হয়েছিল ১৪ লাখ ৫৪ হাজার টন।
গত বছরের তুলনায় এবার চিনি আমদানি কমেছে এক লাখ ১৮ হাজার টন।
এ ছাড়া একই সময়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে চিনি আমদানি হয়েছিল ১৫ লাখ ৪০ হাজার টন। এর পরের অর্থবছরে আমদানি চার লাখ ৫৩ হাজার টন বেড়েছিল। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৯ লাখ ৮৬ হাজার টন চিনি আমদানি করেছিলেন দেশের ব্যবসায়ীরা। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম চিনি আমদানি হয়েছে।
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যে দেখা যায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা আছে ৩০টি, যার বিস্তৃতি চার হাজার বর্গমাইল। এর মধ্যে চোরাপথে চিনি আসে সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, ফেনী এবং চট্টগ্রামের মিরসরাই দিয়ে। চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অর্ধশত অবৈধ চালানের প্রায় এক হাজার টন চিনি জব্দ করেছে।
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর সীমান্ত এলাকা থেকে তিন টন ভারতীয় চিনিসহ দুজনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। ২০ এপ্রিল মধ্যম চাক্তাই চাউলপট্টি এলাকা থেকে লরিবোঝাই ২৫ টন ভারতীয় চিনি জব্দ করা হয়। এর সাত দিন পর ২৭ এপ্রিল বহদ্দারহাট এলাকা থেকে জব্দ করা হয় আরো ৩০ টন চিনি। খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারের চিনি আড়তদার রকিবুল আলম বলেন, ‘শুধুই আমার আড়তে নয়। এখন বেশির ভাগ আড়তে পাওয়া যাবে ভারতীয় চিনি। চোরাই চিনি মণে কমপক্ষে হাজার টাকা কম। এসব চিনি বিভিন্ন কম্পানির নামে প্যাকেটজাত করে বিক্রি হচ্ছে। কিছু চিনি খোলাও বিক্রি হচ্ছে।’ চিনির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘দেশে প্রতিদিন চিনির চাহিদা প্রায় ছয় হাজার টন। এখন অপরিশোধিত চিনি পরিশোধিত হয় সর্বোচ্চ তিন হাজার টন। বাকি চিনি অবৈধভাবে দেশের বাজারে প্রবেশ করছে।’ চিনির আমদানিকারক আরেক প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত কুমার ভৌমিক জানান, চোরাপথে আসা চিনিতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না। অন্যদিকে দেশি গ্রুপগুলোর চিনি বাজারজাত করতে হয় আমদানিমূল্য, পরিবহন, পরিশোধনসহ উৎপাদনমূল্য যোগ করে। ফলে আমদানিকারকরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে বছরে প্রায় ২২ লাখ টন চিনির চাহিদা থাকে। এর মধ্যে ১৫টি রাষ্ট্রীয় চিনিকল বছরে ২৫ হাজার টনের মতো পরিশোধিত চিনি জোগান দেয়, যা চাহিদার মাত্র ১ শতাংশ। বাকি ৯৯ শতাংশ চিনি বেসরকারিভাবে আমদানি করতে হয়। এই অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, আবদুল মোনেম কম্পানি, দেশবন্ধু সুগার ও এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন জানান, ভারত থেকে চোরাই চিনি আসার ফলে সরকার দৈনিক প্রায় ২০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আর লোকসানে পড়ছে দেশি কম্পানিগুলো। তাঁর মতে, এটা বন্ধ করতে হলে সীমান্ত বাহিনীকে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। এ ছাড়া এখন অনেক ইলেকট্রনিক সিস্টেমসহ আধুনিক প্রযুক্তি আছে, সেসব ব্যবহার করে যেকোনোভাবে সীমান্ত দিয়ে চোরাই পণ্য আসা বন্ধ করতে হবে।
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts sent to your email.