আন্তর্জাতিক

একনজরে বাশার আল-আসাদ

সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের জীবন ছিল এক নাটকীয় উত্থান ও পতনে ভরপুর। সংস্কারের প্রতীক হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও সময়ের সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন একজন স্বৈরশাসক। তার শাসনামল গৃহযুদ্ধ, গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য চিহ্নিত হয়েছে। ১৯৬৫ সালে দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন বাশার আল-আসাদ।]

সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদের দ্বিতীয় সন্তান। উচ্চবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। দামেস্ক মেডিক্যাল থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর লন্ডনে চোখের ডাক্তার হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

তার বড় ভাই বাসিল আল-আসাদ ছিলেন পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। তাই বাশার রাজনীতির বাইরে ছিলেন। তবে ১৯৯৪ সালে বড় ভাই বাসিলের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর বাশার পরিবারের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন। বাবার নির্দেশে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং রাজনীতির প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন।

ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে শীর্ষে ওঠা ২০০০ সালে তার বাবা হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বাশার সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। সেই সময় তাকে তরুণ সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে দেখা হয়েছিল। সিরিয়ার জনগণ আশাবাদী ছিল, তিনি দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর বাশার দ্রুতই তার পিতার শাসন কাঠামোকে আরো কঠোর করে তোলেন। রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য তিনি সমালোচিত হন।

আরব বসন্ত এবং গৃহযুদ্ধের সূচনা ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়ায় পৌঁছলে বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং মুক্তির দাবিতে সৃষ্ট এই আন্দোলনগুলো বাশারের শাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তবে তিনি সংলাপের পরিবর্তে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করেন। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর সামরিক অভিযান, বোমাবর্ষণ ও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কারণে দেশটি ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। গৃহযুদ্ধে লাখো মানুষের মৃত্যু ও কোটি মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার জন্য বাশারকে দায়ী করা হয়। তার শাসনব্যবস্থা রাশিয়া ও ইরানের সমর্থন পেলেও আন্তর্জাতিক মহল তাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছে।

পতনের শুরু ২০২৪ সালে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আলেপ্পো, হোমস, এবং হামার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো দখল করে তারা বাশারের সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। বিদ্রোহীদের দ্রুত অগ্রগতির পেছনে আসাদ বাহিনীর দুর্বল প্রতিরোধ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভাজন বড় কারণ। ইরান ও রাশিয়া এত দিন বাশারকে সমর্থন দিয়ে এলেও এখন তারাও সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে আর আগ্রহ দেখায়নি।

দেশত্যাগ বিদ্রোহীরা দামেশক ঘিরে ফেললে পরিস্থিতি বাশারের জন্য আরো সংকটজনক হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, দামেস্কে বিদ্রোহীদের অগ্রযাত্রা শুরু হলে বাশার আল-আসাদ একটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে দেশ ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান।

যুবরাজ থেকে স্বৈরশাসক হয়ে ওঠার বাশার আল-আসাদের গল্প ক্ষমতা এবং দমননীতির এক দুঃখজনক উদাহরণ। তার শাসনামল সিরিয়ার জনগণের জন্য বিভীষিকা হয়ে দাঁড়ায়। দেশত্যাগের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক অধ্যায়ের অবসান হলেও, সিরিয়ার জনগণকে এখনো যুদ্ধের ক্ষত এবং পুনর্গঠনের দীর্ঘ পথে এগোতে হবে। ইতিহাসে বাশার আল-আসাদ একজন ক্ষমতালোভী শাসক হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকবেন, যিনি তার দেশ এবং জনগণের চেয়ে নিজের ক্ষমতাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker