নারীর সৌন্দর্যের নেই কোনো সংজ্ঞা, নেই কোনো আলাদা বিশেষত্ব। একেকজনের কাছে সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা একেক রকম। কেউ গায়ের ফর্সা রঙকে সৌন্দর্যের আসল কারণ বলেন। কেউ বা আবার চাপা রং, দীঘল চুলের প্রেমে পড়েন। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা নারীর সৌন্দর্যকে ব্যাখ্যা করেছেন একেকভাবে।
তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পারস্যের এই গোঁফ বিশিষ্ট পুরুষালী চেহারার রাজকন্যাই ছিলেন তৎকালীন সমাজের দৃষ্টিতে সেরা সুন্দরী। এমনকি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল অনেক পুরুষ। এদের মধ্যে ১৩ জন পুরুষ প্রত্যাখ্যাত হয়ে আত্মহত্যাও করে। তবে এ ঘটনার সত্যতা কতখানি তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।
বেশ কয়েক বছর ধরে গোঁফওয়ালা এক নারীর ছবি ভাইরাল হয় ইন্টারনেটে। ২০১৭ সালে প্রথম গোঁফওয়ালা এক নারীর ছবি ভাইরাল হয় ইন্টারনেটে। সেখানে তাকে প্রিন্সেস কাজার নামেই উল্লেখ করেছিলেন পোস্টকারী। এই নারী নাম প্রিন্সেস কাজার বলা হলেও তার প্রকৃত নাম ফাতেমা খানম। তার উপাধি ইসমত উদ-দৌলা। তিনি সংক্ষেপে প্রিন্সেস ইসমত নামেই অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন তৎকালীন পারস্যের কাজার রাজবংশের রাজা নাসিরউদ্দিন শাহ কাজার এবং তার স্ত্রী তাজ উদ-দৌলার দ্বিতীয় কন্যা। কাজার রাজবংশের রাজকন্যা হওয়ার কারণেই তাকে প্রিন্সেস কাজার বলে চেনেন অনেকে।
নাসিরউদ্দিন শাহ কাজারের ছেলে মেয়ে ছিল ২১ জন। তাদেরই একজন ছিলেন ইসমত উদ-দৌলা। তার জন্ম ১৮৫৫ অথবা ১৮৫৬ সালে। নাসিরউদ্দিন শাহের সময় পারস্যের আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগে তার রাজ দরবারেও। শাহেনশাহ নাসিরউদ্দিন শাহ কাজার ছিলেন কাজার রাজবংশের সবচেয়ে যোগ্য এবং সফল শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার সময়ে পারস্যের ব্যাপক আধুনিকায়ন হয়। এর ফলে পারস্যে ইউরোপীয়দের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বৃদ্ধি পায়।
কাজার রাজবংশ ছিল পারস্যের দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশগুলোর মধ্যে একটি। তুর্কি বংশোদ্ভূত কাজার গোত্রের এ রাজবংশীয় শাসন স্থায়ী হয় ১৭৮৫ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। এ রাজবংশের তৃতীয় রাজা ছিলেন শাহেনশাহ নাসিরউদ্দিন শাহ কাজার।
তিনি তার পিতা মোহাম্মদ শাহ কাজারের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা পান। তার শাসনকাল ছিল পারস্যের ইতিহাসের তৃতীয় দীর্ঘস্থায়ী শাসনকাল। ১৮৪৮-১৮৯৬ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ব্যাপী তিনি পারস্যের শাসনকর্তা ছিলেন।
নাসিরউদ্দিন শাহ কাজারের মেয়ে প্রিন্সেস ইসমতকে সেসময় সবচেয়ে সুন্দরী নারী হিসেবে বিবেচনা করা হত। তবে শুধু প্রিন্সেস ইসমত নন, তার সৎ বোন প্রিন্সেস তাজ আস-সুলতানা ছিলেন সে সময়ের তুলনায় বেশ আধুনিক। প্রিন্সেস ইসমত স্রোতের একদম বিপরীত। প্রচলিত রীতি ভেঙে পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন তিনি। তার শখ ছিল ছবি তোলার। তার বেশিরভাগ ছবিই তুলেছিলেন তার স্বামী দাস্ত মোহাম্মদ খান।
প্রিন্সেস ইসমতের জীবন ছিল ক্ষনস্থায়ী। মাত্র ৫০ বছর বয়সে ১৯০৫ সালে তিনি মারা যান। প্রিন্সেস কাজারের প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পরই মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠে প্রিন্সেস কাজারের ব্যাপারে জানতে। কাজার সাম্রাজ্যের উপর ফারসি ভাষায় বেশ কিছু বই আছে। যেখানে নাসিরউদ্দিন শাহের শাসনামল নিয়েও ইতিহাস রচিত হয়েছে।
তবে কাজার সাম্রাজ্যের নারীদের পোশাক এবং গোঁফ রাখার অদ্ভুত সংস্কৃতির উপরেও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানি অধ্যাপক ড. আফসানেহ নাজমাবাদির একটি বই আছে। সেই বইয়েও প্রিন্সেস ইসমত বা অন্য কোনো রাজকন্যার জন্য ১৩ জন পুরুষের আত্মহত্যার কোনো ঘটনা উঠে আসেনি। এমনকি এগুলোতে প্রিন্সেস ইসমতকে অত্যন্ত গুণী এবং প্রভাবশালী হিসেবে উল্লেখ করলেও তিনি সৌন্দর্যের প্রতীক ছিলেন। তবে পারস্যের পুরুষরা তার জন্য পাগল ছিল, এমন কোনো দাবি করা হয়নি।
১৮৬৬ সালে, যখন তার বয়স মাত্র ১০ বছর, তখন প্রায় সমবয়সী দাস্ত মোহাম্মদ খানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সে সময় পারস্যে বাল্য বিবাহ ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ইসমতের সৎ বোন তাজ আস-সুলতানারও বিয়ে হয়েছিল মাত্র ৯ বছর বয়সে।
কাজেই ইসমতের রূপ দেখে যদি মানুষ মুগ্ধ হয়ও, তবুও একজন বিবাহিতা রাজকন্যাকে পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি সে সময়ের পারস্যের সমাজের প্রেক্ষিতে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পুরো দাবিটির মধ্যে যে একমাত্র বিষয়টির সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলো, সে সময় পারস্যে আসলেই নারীদের গোঁফ রাখার প্রচলন ছিল এবং সেটিকে নারীর সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এমনকি তারা ভ্রুও আঁকতেন মোটা করে। এজন্য আলাদাভাবে কালি তৈরি করে নিতেন তারা।
ইরানি ইতিহাসবিদ ড. আফসানেহ নাজমাবাদির মতে, ঊনবিংশ শতাব্দীর পারস্যের কাজার গোত্রের শৌখিন নারীরা সৌন্দর্যচর্চার অংশ হিসেবে হালকা গোঁফ রাখতে পছন্দ করতেন। আবার অনেকেই প্রিন্সেস কাজার বলতে ইসমত না, বরং তার সৎ বোন তাজ আস-সুলতানাকে বোঝানো হয়েছে বলে দাবি করেন। আধুনিক মাপকাঠিতে তাজ আস-সুলতানাকে ইসমতের তুলনায় অনেক বেশি সুন্দরী বলে মনে হতে পারে।
এছাড়া তাজ আস-সুলতানা ছিলেন একইসঙ্গে নারীবাদী ও জাতীয়তাবাদী। তিনি নিজে হিজাব পরিত্যাগ করেছিলেন, নারীদের আধুনিক শিক্ষা ও চাকরি এবং পারস্যের সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মতামত গড়ে তুলেছিলেন। তবে তার ব্যাপারেও ইতিহাসে ১৩ জনের আত্মহত্যা সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে ইতিহাসে ঊনবিংশ শতাব্দীর এই দুই নারীর জীবনী সম্পর্কে জানা যায়। যাদের সৌন্দর্যের চেয়ে অন্যান্য কর্মকাণ্ডই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইতিহাসবিদ ড. স্টাসি জেম শেউইলারের মতে, তাদের সময়ে ইসমত এবং তাজ তাদের সৌন্দর্যের জন্য খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না। বরং তারা তাদের মেধা ও যোগ্যতাই ছিল তাদের মূল পরিচয়। বিশেষ করে তাজ আস-সুলতানা ছিলেন সেসময়ের খুবই প্রভাবশালী একজন নারী।
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts sent to your email.