সোমালিয়ার সশস্ত্র জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেনসহ ২৩ নাবিকের দেশে থাকা স্বজনরা উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত থেকে নাবিকদের সঙ্গে পরিবার-স্বজনদের যোগাযোগ অনেকটাই বিচ্ছিন্ন।
জিম্মি থাকা নাবিকরা কোথায় কী অবস্থায় আছেন, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। তবে জাহাজটি দু-এক দিনের মধ্যে সোমালিয়ার কোনো বন্দরে নোঙর করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে সোমালি জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত স্থান পরিবর্তন করে চলেছে সশস্ত্র জলদস্যুরা।
মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে আরব আমিরাতে যাচ্ছিল জাহাজটি। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টার দিকে জাহাজটিতে উঠে নিয়ন্ত্রণ নেয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জাহাজটিতে ৫৫ হাজার টন কয়লা রয়েছে।
২৩ জন নাবিকের সবাই বাংলাদেশি। জলদস্যুরা জাহাজটির দখল নেওয়ার সময় সেখানে ২৫ দিনের মতো খাবার ও ২০০ টন বিশুদ্ধ পানি ছিল।
জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ ও নাবিকদের যেকোনো মূল্যে সুস্থ অবস্থায় নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে নানাভাবে চেষ্টা চলছে বলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আনাম চৌধুরী গতকাল বিকেল ৪টার দিকে বলেন, জিম্মি করার পরপর জলদস্যুরা নাবিকদের মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ নিয়ে নেয়।
একই সঙ্গে জাহাজের নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ স্থাপনের যে ডিভাইস ছিল, সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে করে তাঁদের সঙ্গে গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার পর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ওই সময় সোমালিয়া থেকে ২৭৫ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল এমভি আবদুল্লাহ। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে সোমালিয়ার কোনো বন্দরে জাহাজটি নোঙর করতে পারে বলে ধারণা করছেন কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী ক্যাপ্টেন মেহেরুল করিম। তিনি বলেন, ‘আমরা জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছি।
বিশেষ ব্যবস্থায় গতকাল সকাল ৭টায় জাহাজে থাকা নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। নাবিকরা জানান, তাঁরা সুস্থ রয়েছেন।’
জিম্মি হওয়া এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি কেএসআরএম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং কম্পানির। ওই গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম গতকাল বিকেলে বলেন, ‘এখনো ২৩ নাবিককে জিম্মি করার ঘটনায় আমাদের কাছে কোনো ধরনের মুক্তিপণ দাবি করা হয়নি। জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। আমাদের সঙ্গে জলদস্যুদের কেউ যোগাযোগ করেনি। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং চলছে। উদ্ধারপ্রক্রিয়ায় সময় লাগতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত যে তথ্য রয়েছে, ক্যাপ্টেনসহ নাবিকদের সবাই সুস্থ আছেন।’
গত মঙ্গলবার রাতে জলদস্যুদের কবল থেকে নিজেদের বাঁচাতে আকুতি জানিয়ে পরিবারসহ মালিকপক্ষের কাছে অডিও বার্তা পাঠান জিম্মিদশায় থাকা নাবিকদের কেউ কেউ। অডিও বার্তায় নাবিকরা জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন, তাঁদের কিছু হয়ে গেলে দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের যেন দেখভাল করা হয়।
মুক্তিপণ না দিলে জলদস্যুরা জাহাজের নাবিকদের একে একে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দিয়েছে। জিম্মি থাকা নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
জিম্মি থাকা ২৩ নাবিকের মধ্যে ১১ জনই চট্টগ্রামের বাসিন্দা। অন্যরা দেশের অন্য ১০ জেলার বাসিন্দা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর থেকে উত্কণ্ঠিত পরিবারের সদস্যরা গতকাল সকাল থেকে দিনভর চট্টগ্রাম নগরের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদে জাহাজের মালিকপক্ষের কার্যালয়ে জড়ো হয়। সর্বশেষ খবরাখবর জানতে চেয়েছে তারা।
এ সময় তাদের চোখেমুখে গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা গেছে। মালিকপক্ষ সবাইকে সুস্থ ও নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে বলে তাদের জানায়।
‘আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলছে’
জাহাজের চিফ অফিসার মো: আতিক উল্লাহ খান তাঁর স্ত্রীকে পাঠানো এক অডিও বার্তায় বলেন, ‘আমাদের মোবাইল ফোন নিয়ে নিচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলছে। এদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলছে। এই মেসেজটা সবাইকে পাস করে দিও।’
মোবাইলসহ সব যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে যাচ্ছে
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আমিন শরীফের ছেলে জাহাজের জিএস মোহাম্মদ নূর উদ্দিনের পাঠানো অডিও ক্লিপে রয়েছে, ‘কারো সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাইরেটরা আমাদের মোবাইলসহ সব যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে যাচ্ছে। এখানে টাকা না দিলে আমাদের একজন একজন করে সবাইকে মেরে ফেলবে বলছে। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
জাহাজে জিম্মি অয়েলার চট্টগ্রামের আনোয়ারার মোহাম্মদ সামসুদ্দিন শিমুলের মা সাগেরা বেগম বলেন, “সন্ধ্যায় ছেলে ফোন করে বলে, ‘ডাকাতদল আমাদের জিম্মি করে রেখেছে। একটু পর মোবাইল ফোনও নিয়ে নেবে। আমাদের জন্য দোয়া করিও।’ তিনি বলেন, এটাই আমার কলিজার টুকরার (শিমুল) সঙ্গে শেষ কথা। জাহাজ কর্তৃপক্ষ ও সরকারের কাছে অনুরোধ করছি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে।”
তাঁর স্ত্রী ফারজানা আকতার বলেন, ‘জাহাজ কর্তৃপক্ষ আমাদের তাদের অফিসে ডেকেছে। জিম্মি সব নাবিককে সুস্থ অবস্থায় উদ্ধারে তারা চেষ্টা চালাচ্ছে বলে আমাদের জানিয়েছে।’
জিম্মি জাহাজের এ বি আসিফুর রহমানের বাবা মোহাম্মদ আখতার হোসেন বলেন, ‘ছেলেটাকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। পাঁচ মাস হলো নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে। এর মধ্যে এই দুঃসংবাদ। আমাদের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। ডাকাতরা কারো কোনো ক্ষতি করেনি বলে জানিয়েছে।’
স্ত্রীর সঙ্গে মঙ্গলবার রাতে সর্বশেষ যোগাযোগ সাইদুজ্জামানের
নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, জাহাজটিতে চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত নওগাঁ সদর উপজেলার এ এস এম সাইদুজ্জামান। জলদস্যুদের হাতে আটকের পর শেষবারের মতো বাবা ও স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তিনি।
সাইদুজ্জামানের স্ত্রী মাননা তাহরীন বলেন, মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে সর্বশেষ কথা কথা হয় স্বামীর সঙ্গে। তখন ও ইফতার করার কথা জানায়।
মায়ের কাছে মাফ ও দোয়া চাইতেই ফোন কেটে গেল
খুলনা প্রতিনিধি জানান, জাহাজটির সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো: তৌফিকুল ইসলামের বাড়ি খুলনা মহানগরীর বয়রা করিমনগর এলাকায়। গত মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে মায়ের সঙ্গে শেষ কথা হয় তাঁর। মা বলেন, “ছেলে বলল, ‘আম্মা, আমি ভালো আছি। তুমি দোয়া কইরো, আল্লাহ কবুল করবেন।’ আর কথা হয়নি, কিছু শুনতে পারছিলাম না। মোবাইলটা হয়তো কেড়ে নিয়েছে।”
সবার সহযোগিতা কামনা তারেকের বাবার
ফরিদপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, জাহাজের থার্ড অফিসার তারেকুল ইসলামের বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ছকড়িকান্দি গ্রামে। বাড়িতে তারেকের বাবা দেলোয়ার হোসেন নিবিষ্ট মনে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করছেন। সাংবাদিকদের কাছে সন্তানকে ফিরে পেতে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
বাড়িতে নবপরিণিতা স্ত্রী রেখে গেছেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আলী হোসেন
বানারীপাড়া (বরিশাল) প্রতিনিধি জানান, আড়াই মাস আগে ওই জাহাজে নাবিক হিসেবে যোগ দেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হোসেন (২৬)। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিশারাকান্দি ইউনিয়নের উমারের পাড় গ্রামে তাঁর বাড়ি। তাঁর সদ্যোবিবাহিতা স্ত্রী ইয়ামনি বলেন, ‘কোরবানির ঈদে বাড়িতে ফেরার কথা আলীর। দুজনে মিলে ঈদের ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাব ভেবেছিলাম। এখন কী যে হবে!’
একমাত্র ভাই সাব্বিরকে ফিরে পেতে ব্যাকুল বোন
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, জাহাজে জিম্মি নাবিক সাব্বিরের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার সহবতপুর ইউনিয়নের ডাঙা ধলাপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী। সাব্বিরের একমাত্র বোন মিতু আক্তার বলেন, ‘আমার ভাই গত সোমবার বিকেলে ফেসবুকে আপলোড দিয়েছে যে বিষুব রেখা অতিক্রম করলাম। এক মাস আগে সে বাড়ি আসছিল। এক দিন থেকেই সে চলে গেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।’ একমাত্র ভাইকে ফিরে পেতে তিনি ব্যাকুল।
আনোয়ারুলের বাড়িতে কান্নার রোল
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, নাবিক মো: আনোয়ারুল হক রাজুর (২৯) বিপদের কথা জেনে তাঁর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বাড়িতে চলছে কান্নার রোল। গতকাল দুপুরে রামপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আজিজুল হক মাস্টার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আনোয়ারুলের মা-বাবা আর ভাই-বোন সবাই কান্নাকাটি করছেন।
আনোয়ারুলের বড় ভাই মো: জিয়াউল হক রনি বলেন, “গত সোমবার সে আমার মোবাইলে মেসেজ পাঠায়—‘সোমালিয়ান পাইরেটস অনবোর্ড, বাঁচি থাকলে দেখা হবে, দোয়া কইরেন…।’”
ক্যাডেট ইঞ্জিনিয়ার আইয়ুবের মায়ের আর্তনাদ
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডেট আইয়ুব খান লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা। বাড়ি রায়পুরের রাখালিয়া গ্রামে। মাসখানেক আগে তাঁর বাবা আজহার মিয়া মারা যান। এখনো সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি পরিবারটি। এর মধ্যে পরিবারের ছোট ছেলে জলদস্যুদের কবলে। এ শোকে আইয়ুবের মা হোমায়রা বেগম ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাবারে চাই।’
সিম্যান জয়ের বাড়িতে মা-বাবার আহাজারি
নাটোর ও বাগাতিপাড়া প্রতিনিধি জানান, জাহাজের অর্ডিনারি সিম্যান (ওএস) জয় মাহামুদের বাড়ি নাটোরের সালাইনগর দক্ষিণ পাড়া গ্রামে। একমাত্র ছেলের জিম্মিদশার খবরে বাবা জিয়াউর রহমান ও মা আবিদা বেগম আহাজারি করছেন।
বাবা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলেসহ জিম্মি সব নাবিককে দ্রুত উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
বিপ্লবকে ফিরে পেতে স্ত্রী-সন্তানদের আকুতি
ফেনী প্রতিনিধি জানান, নাবিক ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ বিপ্লবের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঁইয়া ইউনিয়নের মোমারিজপুর গ্রামে। পরিবার ফেনী শহরে নাজির রোডে ভাড়া বাসায় থাকে। তাঁর স্ত্রী উম্মে সালমা জানান, তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ গতকাল সকাল ১০টায় কথা হয়েছে। তাঁরা নিরাপদে আছেন বলে জানিয়েছেন।
‘আম্মা আমার জন্য দোয়া করিও’
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, নাবিক রোকন উদ্দিনের বাড়ি সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের বাঘরোয়া গ্রামে। মোবাইল ফোনে মায়ের সঙ্গে গত সোমবার কথা হয় তাঁর। মা জানান, এ সময় রোকন উদ্দিন বলেন, ‘আম্মা, রোজা রাখিও। আমিও রাখব। আমার জন্য দোয়া করিও।’ সর্বশেষ গত মঙ্গলবার দুপুরে মোবাইল ফোনে স্ত্রী তানিয়া আক্তারের সঙ্গে কথা হয় রোকন উদ্দিনের। এ সময় ভয়ার্ত কণ্ঠে স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘জাহাজটি জলদস্যুরা ঘিরে ফেলছে। মোবাইল ফোন কেড়ে নিচ্ছে। আর কথা বলতে পারব না। দোয়া করিও।’ এ কথা বলার পর থেকে রোকন উদ্দিনের ফোন বন্ধ।