ইতিহাস ও ঐতিহ্য

কিংবদন্তি কমল দাশগুপ্ত শেষ জীবনে মুদির দোকান, অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু

কিংবদন্তি কমল দাশগুপ্ত শেষ জীবনে মুদির দোকান, অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু। শেষ জীবনে মুদির দোকান, অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু অথচ কিংবদন্তি কমল দাশগুপ্ত ১৯৪৬ সালে ৩৭ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছেন, তিনি গাড়ি ছাড়া পা রাখেন নি কোলকাতার রাস্তায়! কাজী নজরুল ইসলামের প্রায় ৪০০ টি গানে সুর করেছেন এই অসাধারণ প্রতিভাধর সুরকার।

উল্লেখ্য, কমল দাশগুপ্ত’র কথা মনে পড়লো কারণ তাঁর পুত্র সাফিন আহমেদ কয়েক দিন আগে মারা গেছেন। কমল দাশগুপ্ত মারা গিয়েছিলেন ৬২ বছর বয়সে, পুত্রও একই বয়সে মারা গেলেন। কমল দাশগুপ্ত আর ফিরোজা বেগমের  তিন পুত্রের প্রতিভা কমল দাশগুপ্ত আর ফিরোজা বেগমের মিলিত  প্রতিভার ধারে কাছে আসতে পারেনি, যদিও বলা হয় মিউজিশিয়ানদের সন্তানেরা ভাল মিউজিশিয়ান হন। দুই পুত্র গান গেয়েছেন, হয়তো ভাল মিউজিশিয়ান হয়েছেন কিন্তু পিতার মতো যাদুকর হতে পারেননি। 

প্রসঙ্গত, এমনি বরষা ছিল সেদিন, মেনেছি গো হার মেনেছি, ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে তোমারে করেছে রানী, তুমি কি এখন দেখিছো স্বপন, এই কিগো শেষ দান বিরহ দিয়ে গেলে, আমি ভুলে গেছি তব পরিচয়, যেথা গান থেমে যায়, আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড় তুমি যে বহ্নি শিখা, জেগে আছি একা, আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে, সেদিন নিশীথে বরিষণ শেষে চাঁদ উঠেছিল বনে, শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে, চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়, তুমি হাতখানি যবে রাখো মোর হাতের পরে, আমার যাবার সময় হলো, কতদিন দেখিনি তোমায়, হার মেনেছি গো হার মেনেছি, জানি জানি গো মোর শূন্য হৃদয় দেবে ভরি, বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে, পথহারা পাখি কেঁদে মরে একা, আমি চাঁদ নহি অভিশাপ, গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়…ছোটবেলায় এই গানগুলো শুনতাম আমাদের বাড়িতে। এগুলো এবং এরকম আরও হাজার রকম গান ছিল আমার দাদার সংগ্রহে। বাড়ির রেকর্ডপ্লেয়ারে বাজতো গান। সারা পাড়া শুনতো। দাদা বলতো গানগুলোর সুরকার কমল দাশগুপ্ত। তখনই প্রথম কমল দাশগুপ্তর নাম শুনি। ফিরোজা বেগম নজরুলগীতি গাইলে সবাই ভাবতো সুর বুঝি কাজী নজরুল ইসলামের।

Image

অবিশ্বাস্য প্রতিভা ছিল কমল দাশগুপ্ত’র। ১৯৩০ সালে তাঁর সুরারোপিত গানের প্রথম রেকর্ড বের হয়। এইচ.এম.ভি গ্রামোফোন কোম্পানিতে  মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা ও গানের সুর করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মোট ৮৫০০ গানে তিনি সুর করেছেন। খেয়াল, রাগ প্রধান গান, ভজন, কীর্তন, কাওয়ালি, ইসলামী সঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান, উর্দু ও হিন্দিগীত, গজল, লোকসঙ্গীত, মার্চ সঙ্গীত ও সিনেমার গানে রয়েছে তার অবিস্মরণীয় অবদান। 

১৯৪৩ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব মিউজিক ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতার জীবন্ত কিংবদন্তী ১৯৬৭ সালে স্ত্রী পুত্রসহ ঢাকায় স্থায়ী হন। কেন তাঁকে ঢাকায় অনিশ্চিত জীবনে আসতে হয়েছিল? তিনি তো কলকাতায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন! ১৯৫৫ সালে স্বনামধন্য নজরুল সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করার জন্য কি একা হয়ে গিয়েছিলেন? ধন দৌলত, যশ খ্যাতি, সুনাম, জনপ্রিয়তা সব তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল? ঢাকাও কিন্তু এই আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারীকে সম্মান করেনি। নিজের ধর্ম সম্পর্কে উদাসিন এক মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী সঙ্গীতসাধককে ঢাকা ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেছিল! বাধ্য করেছে নিজের কমল দাশগুপ্ত নাম ত্যাগ করে মোহাম্মদ কামালউদ্দিন নামটিকে বরণ করতে। বাধ্য করেছে তাঁকে চরম দারিদ্রের মধ্যে জীবনযাপন করতে। বাধ্য করেছে তাঁকে হাতির পুলে মুদির দোকান দিয়ে মুদিগিরি করতে, লজেন্স বিস্কুট বিক্রি করতে। ঢাকা এই অসামান্য শিল্পীকে বাধ্য করেছে অবহেলা আর উপেক্ষায় জীবন কাটাতে। বাধ্য করেছে তাঁকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করতে।

বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের লোকেরা কি কখনও ক্ষমা চেয়েছেন কমল দাশগুপ্তের কাছে? বনানীতে তাঁর কবরে কখনও ফুল দিতে যান? আক্ষেপ করেন? লজ্জা পান? কখনও তাঁর গানের অনুষ্ঠান করেন? তাঁকে শ্রদ্ধা জানান? জানতে ইচ্ছে করে।

পুনশ্চঃ কমল দাশগুপ্ত ছিলেন বাংলা হিন্দি তামিল চলচ্চিত্রের প্রচুর গানের সুরকার, আধুনিক বাংলা গানের সুরস্রষ্টা, গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গীত পরিচালক এবং সর্বাধিক নজরুল গীতির সুরকার। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় ৮০টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘যোগাযোগ’ ‘শেষ উত্তর’ ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে ভূষিত হয়। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর রণসঙ্গীত ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’ তাঁর অনন্য সৃষ্টি। প্রতিমাসে গড়ে ৫৩টি গানে সুর করার কৃতিত্ব ছিল তাঁর। ঢাকার হাতির পুলে এই তাঁর মুদি দোকান ‘পথিকার’। কমল দাশগুপ্ত দোকানদারি করেছেন। তেল নুন মুড়ি বিস্কুট বিক্রি করেছেন!

Author

দ্বারা
উজ্জ্বল রায়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker