কিশোরগঞ্জ

বিলুপ্তির পথে শামুক-ঝিনুক

ঝিনুক নেব না বলিনি, শামুকও নেব;
বিনিময়ে শামুক-ঝিনুক এলোমেলো
করার সাড়ে ছ’ইঞ্চি এই ছুরিটা ধারালো,
তোমাকে দেব।

মারজুক রাসেলের লেখা কবিতার এ পঙক্তিটি শামুক-ঝিনুকের মহা মর্যাদার কথা নির্দেশ করে।অর্থ কিম্বা আবেগের সুবিশাল একটা যায়গা জুড়ে শামুক-ঝিনুকের বাস।

– এক সময় ঢুল শ্রেণীর লোকেরা নদী নালায় খাল-বিলে জলাশয়ে ঝিনুক কুড়িয়ে মুক্তা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে শামুক, ঝিনুক বিলুপ্তির কারণে ঢুল শ্রেণীর লোকেরা পেশা পাল্টিয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন।কারণ ঝিনুক ও শামুকের বিচরণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে খাল, বিল, ডোবা, নালা ও পুকুরসহ নানা রকম প্রতিকূল পরিবেশের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে জীববৈচিত্র। কিছু অসাধু চক্র নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসে মেতে উঠেছে। সরকারী খাল, বিল, ডোবা নালা গুলো প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে। প্রভাবশালীরা এ গুলো দখল করে ভরাট করে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ পুকুর খনন করে বাণিজিকভাবে মাছ চাষ করছে। এতে করে প্রকৃতির বন্ধু শামুক ও ঝিনুকের আশ্রায়স্থল হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে শামুক ও ঝিনুক প্রায় বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে নানা প্রতিকুলতার কারনে পানি উৎসের স্তর কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন আর পানি উৎসের সংকটের কারণে বিপন্ন হচ্ছে শামুক-ঝিনুক, বিভিন্ন পোকামাকড় আর কয়েক প্রজাতির মাছ ও প্রাকৃতিক শাকসবজি।

যদি সুন্দর একখান মন পাইতাম,
সদরঘাটের পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম…’
বা ‘পান খেয়ে ঠোঁট লাল করিলাম,
বন্ধুর দেখা পাইলাম না…’

পান নিয়ে এ রকম কতইনা জনপ্রিয় গান আছে বাংলা সংস্কৃতিতে। আর এ পান তৈরির অন্যতম উপাদান হল চুন। কিন্তু চুন তৈরির শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।

রসনা বিলাসী মানুষের কাছে পান একটি অতি প্রিয় খাবার। সেই পানের স্বাদ যোগায় চুন। জলবায়ূ পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে চুন তৈরির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত শামুক ও ঝিনুক। এছাড়াও ঝিনুক আর শামুকের বহুগুণ উপকারিতা রয়েছে।

শামুকের খোলসের ভেতরের নরম অংশ মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। শামুকের বিলুপ্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পরছে মাছ উৎপাদনে। দেশীয় মাছ কৈ, শিং, টাকি, টেংরা, শৈল মাছের ডিম থেকে সদ্যজাত পোনার একমাত্র খাদ্য হচ্ছে শামুকের নরম ডিম। আর এ খাবার না পেলে ঐ পোনা মাছ মারা যায়। এভাবে শামুক নিধন হতে থাকলে দেশী প্রজাতির মাছ আরো বেশি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

অপর দিকে শামুক নিসৃত পানির রয়েছে নানান ঔষধি গুন। প্রচলিত রয়েছে ঠান্ডা পাত্রে রক্ষিত শামুক নিসৃত পানি যে কোন ধরণের চোখের রোগের জন্য খুবই উপকারী। শামুক ঝিনুক দিয়ে তৈরী করা হচ্ছে চুন এমনকি হাঁসের খাবার হিসেবে ও যোগান দেওয়া হয় প্রাকৃতিক ফিল্টার খ্যাত শামুক-ঝিনুক। শামুক আর ঝিনুক পচে জমির মাটিতে প্রাকৃতিক ভাবে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশ সরবরাহ করে।ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধিসহ ধানগাছের শিকড় মজবুত ও ফলন অধিক হতে সাহায্য করে। শামুক দূষিত পানি ফিল্টারিং করে প্রাকৃতিকভাবে পানি দূষণ মুক্ত রাখে। নির্বিচারে ঝিনুক শামুক নিধনের ফলে কৃষিজমি হারাচ্ছে উর্বরতা ও পরিবেশ হারাচ্ছে স্বাভাবিক ভারসাম্যতা। দ্রুত নদী- নালা, ডোবা, চলাশয় খনন করে শামুক ঝিনুকের আশ্রয়স্থল গড়ে তোলার জন্য জোরালো দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।

হোসেনপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক আশরাফ আহমেদ বলেন, উন্মুক্ত জলাশয়ের বিশেষ করে খাল, বিল, হাওর, বাওরে বংশ বিস্তার করে থাকে শামুক ও ঝিনুক। অন্যদিকে জলাশয়ের নোংরা পানির পোকামাকড় আহার করে পানি বিশুদ্ধকরণের কাজ করে। শামুক এবং ঝিনুক আমাদের নীরব বন্ধু। এই শান্ত ধীরগতি স্বভাবের প্রাণী নীরবে আমাদের উপকার করছে। উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি বিশুদ্ধকরণসহ স্থানীয় মিঠা পানির মাছের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে শামুক।এই ঝিনুক এখন বিলুপ্তপ্রায়।ঝিনুক ও শামুকের বিস্তারে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি দেশে পরিকল্পিতভাবে মুক্তার চাষ ও উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আমাদের দেশ লাভবান হবে। এই পদ্ধতিতে মাছের সাথে মুক্তা চাষ করে অনেক চাষিরাই স্বাবলম্বী হতে পারবেন।

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker