সারাদেশ

‘আব্বা ছাড়া আমাগো আর কেউ নাই’

‘আমার আব্বায় ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে বাড়ির সামনে দোকানের সামনে গেছিল। এ সময় টুকু ফরাজীর লোকজন আমার আব্বার হাত-পা বেঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করছে। তারপর তার লাশ গুম করতে পুকুরে ফালাইয়া দিছিল। আমার আব্বা ছাড়া আমাগো আর কেউ নাই।আব্বারে ছাড়া ছোড ছোড ভাই-বোন নিয়া আমরা কেমনে বাঁচুম।’

প্রিয় বাবাকে চিরতরে হারানোর পর আহাজারি করতে করতে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা করছিল নিহত হিরু মাতুব্বরের বড় মেয়ে রুমি আক্তার (১০)। 

হিরু মাতুব্বর (৩৫) পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। তিনি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের আর্য্যদত্তপাড়া এলাকায় এসকেন্দার মাতুব্বরের ছেলে।

 

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দত্তপাড়া ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তারকে কন্দ্র করে ইউনিয়ন বিএনপির নেতা মালেক মোল্লার সঙ্গে একই ইউনিয়নের আরেক বিএনপি নেতা শাহাদাৎ আকনের হাত ধরে সদ্য আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগ দেওয়া টুকু ফরাজীর বিরোধ চলে আসছিল। 

গত রবিবার রাতে এই দুই পক্ষের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এরই জেরে উভয় পক্ষের লোকজন সোমবার দুপুরে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এলাকায় মহড়া দিয়ে আবারও সংঘর্ষে জড়ান। এতে আহত হন উভয় পক্ষের অন্তত ছয়জন।

এদিন দুপুর ১২টার দিকে হিরু ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে বাড়ির অদূরে একটি দোকানের সামনে গেলে প্রতিপক্ষ টুকু ফরাজীর লোকজন তাকে একা পেয়ে হাত-পা বেঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে লাশ পাশের পুকুরে ফেলে দেয়। 

এ ঘটনায় নিহত হিরুর বাবা এসকেন্দার মাদবর বাদী হয়ে সোমবার রাত ২টার দিকে শিবচর থানায় একটি হত্যা মামলা  করেন। এতে ৬৫ জনকে এজাহারভুক্ত ও ৬০-৭০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে। এর পর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে খাড়াকান্দি ও আর্য্যদত্তপাড়া এলাকা প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। থমথমে পরিবেশ থাকায় এসব এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে। এ ঘটনায় মো. সুমন (১৮) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সুমন দত্তপাড়া ইউনিয়নের সাইলা এলাকার তোকান মাতুব্বরের ছেলে।

হিরুর স্ত্রী রোজিনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী রাতের বেলা কাম কইরা দেড়ি কইরা ঘুমাইছে। দুপুর ১২টার দিকে ঘুম থেকে উইঠা দাঁত ব্রাশ করতে করতে বাড়ির পাশেই একটা দোকানের কাছে গেছিল। ওখানেই হেরে (হিরুকে) একা পাইয়া শত্রুরা কোপাইয়া মাইরা ফালায়। আমার স্বামীর কী দোষ ছিল। আমার সন্তানগো কী হইবে? সংসারডা আমার ভাইসা গেল।’

নিহত হিরুর বোন জামাই এমদাদ মাতুব্বর বলেন, ‘ফরাজীরা (স্থানীয় বিএনপির একটি গ্রুপ) মূলত এলাকায় ঢুকছিল একটা মার্ডার করতে। তাদের টার্গেট ছিল মালেক মোল্লার কাউকে পেলে খুন করার। কিন্তু তাদের কাউকে না পেয়ে পাইছে হিরুকে। তখন হিরু দাঁত ব্রাশ করতে করতে ঘর থেকে ৪০০ মিটার দূরে একটি দোকানের সামনে যায়। তখনই ফরাজীদের লোকজন হিরুকে ঘিরে ধরে হাত-পা বেঁধে মেরে পানিতে ফেলে দেয়।

হিরুর বড় বোন ইতি বেগম বলেন, ‘পুরো পরিবারটি হিরুর ওপর ছিল। ওর বাচ্চাগুলোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ওরা এখনো বোঝে না ওদের বাবা আর নেই। বড় মেয়েটা শুধু কান্না করছে। হত্যাকারীরা শুধু হিরুকে হত্যা করেই চলে যায় নাই, আমাদের আশপাশের কমপক্ষে ৭টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালাইছে। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি চাই।’

মামলার বাদী ও হিরুর বাবা এসকেন্দার মাতুব্বর বলেন, ‘আমার একমাত্র পোলাডারে ওরা খুন করছে। হামলাকারী সবাই টুকু ফরাজির লোকজন। পুলিশ আসামিদের ধরছে না। এলাকায় অভিযান চালালে পুলিশ আসামিদের ধরতে পারবে। আমি শুধু আমার পোলার হত্যাকারীগো বিচার দেইখা মরতে চাই।’ 

অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে টুকু ফরাজির বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোন নম্বরে কল দিলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

অভিযুক্ত স্থানীয় বিএনপি নেতা শাহাদাত আকন বলেন, ‘টুকু ভাই বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তিনি কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেন তিনি।’

শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোকতার হোসেন বলেন, ‘নিহত হিরুর লাশ মঙ্গলবার দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। পরে নিহতের পরিবারের কাছে লাশটি হস্তান্তর করা হয়েছে। বিকেলে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে হিরুর লাশ দাফন করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় টুকু ফরাজীসহ অন্য আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আসামিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। তাদের লোকেশন অনুসরণ করে অভিযান চলছে। আশা করছি, দ্রুতই হত্যাকাণ্ডে জড়িত মূল আসামিদের পুলিশ আইনের আওতায় নিয়ে আসবে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker