অর্থনীতি

টাকা ছাপাতেই বছরে খরচ ৫০০ কোটি

নতুন টাকা ছাপাতে সরকারকে প্রতিবছর খরচ করতে হয় মোটা অংকের টাকা। ব্যবহারের পদ্ধতিগত কারণে কাগুজে এসব নোটের স্থায়িত্ব কমছে। ছয় মাস না যেতেই ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে কাগুজে নোট। সে তুলনায় খরচ বেশি হলেও ধাতব কয়েনের স্থায়িত্বও অনেক বেশি। চাহিদা অনুযায়ী প্রতিবছর শুধু নতুন নোট ছাপাতে সরকারের খরচ হয় চার থেকে পাঁচশ কোটি টাকা। খরচে লাগাম টানতে ক্যাশলেস কিউআর (কুইক রেসপন্স) লেনদেনে ঝুঁকছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জাগো নিউজকে এ তথ্য জানায়। একটি সূত্র বলছে, এখন আর আগের মতো বেশিদিন টিকছে না টাকা। ছয় মাসেই নষ্ট হচ্ছে কাগুজে নোট। যেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষণ করার পর তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। পুড়িয়ে ফেলা ব্যবহার অযোগ্য নোট ও বাজার সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেই পরে নতুন নোট আনা হয়। অর্থাৎ, নতুন নোট ছাপানো হয়। এক্ষেত্রেও মার্কেট টুলস ব্যবহার করে পর্যালোচনা করে দেখা হয়, কী পরিমাণ নতুন টাকার দরকার পড়ে। সেভাবেই ছাপিয়ে বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে ছাড়া হয়।

কাগুজে নোটে খরচ বেশি পড়ায় বিকল্প চিন্তাও করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ধীরে ধীরে ক্যাশলেসের দিকে এগোচ্ছে আর্থিকখাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এজন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকায় শুরু করা হয়েছে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন। যে মাধ্যমকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে নেওয়া হচ্ছে উদ্যোগ।

তবে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেনকে সাধুবাদ জানালেও এ বিষয়ে আরও সচেতন ও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কিউআর কোডের মাধ্যমে সর্বত্র লেনদেনের ধারণা কতটা আছে সেটাও দেখতে হবে। এতেও জালিয়াতি-চুরি হতে পারে। সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন অনেকে। এতে সচতেনতাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে টাকা ছাপানোর কারখানা রয়েছে মোট ৬৫টি। বাংলাদেশের কারখানাটির নাম টাঁকশাল। টাঁকশালে টাকা ছাপানো শুরুর আগে অন্য দেশ থেকে ছাপানো হতো। এর মধ্যে রয়েছে- সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইংল্যান্ড। টাঁকশালের টাকা ছাপানোর ধাপগুলো খুবই গোপনীয়। সেখানে প্রায় ১২টি ধাপ পেরোতে হয় টাকা তৈরির জন্য। কারখানার অভ্যন্তরে সব কর্মচারীর মোবাইল ফোন কিংবা যে কোনো ধরনের ডিভাইস ব্যবহারও নিষিদ্ধ।

দেশে কবে কোন নোটের প্রচলন
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালে। এরপর ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ দেশের নিজস্ব কাগুজে মুদ্রা চালু হয়। মানচিত্র খচিত প্রথম নোটটি ছিল এক টাকার। এক টাকার নোটটিতে অর্থসচিব কে এ জামানের স্বাক্ষর ছিল। ১৯৭৩ সালে ৫, ১০ ও ১০০ টাকার নোট ইস্যু করে বাংলাদেশ। এরপর ৫০ ও ৫০০ টাকার নোটের প্রচলন করা হয় ১৯৭৬ সালে। ১৯৭৯ সালে ইস্যু করা হয় ২০ টাকার নোট। দেশে দুই টাকার নোট চালু হয় ১৯৮৮ সালে। ২০০৯ সালের ১৭ জুলাই বাজারে আনা হয় সবচেয়ে বেশি মানের ১০০০ টাকার ব্যাংকনোট। আর ২০২০ সালে সবশেষ বাজারে আসে ২০০ টাকার নোট।

কোন নোট ছাপাতে কত খরচ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ১০০০ টাকার নোট ছাপাতে ৫ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট ছাপানোয় খরচ পড়ে সাড়ে ৪ টাকা। এছাড়া ২০০ টাকার নোটে তিন টাকার কিছু বেশি, ১০০ টাকার নোটে ৪ টাকা, ১০, ২০, ৫০ টাকার সবগুলো নোটই দেড় টাকা খরচ পড়ে। আর ৫ টাকা, ২ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে প্রায় দেড় টাকা।

সবচেয়ে বেশি খরচ পড়ে কয়েন তৈরিতে। প্রতিটি কয়েন তৈরিতে সেই মানের প্রায় সমান সমান টাকা খরচ পড়ে যায়। তবে কয়েনে বেশি অর্থ খরচ পড়লেও টেকসই বেশি। এসব নোট ছাপাতে বছরে বিপুল অংকের অর্থ খরচ হয়। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ক্যাশলেসের দিকে এগোতে চায়।

কাগুজে নোটের মেয়াদ কতদিন?
অনেক সময় নোট বাতিলের বিষয়ে নানা বিভ্রান্তিকর খবর ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিভ্রান্তিকর তথ্যে জনমনেও ভীতি তৈরি হয়। এতে দেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপনার স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। কোনো নোট ব্যবহারের নির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। তবে এখন ছাপা নোট ছয় মাসের বেশি স্থায়ী হচ্ছে না। বেশি টেকসই হয় কয়েন। ব্যবহারে পুরোনো হওয়া যে কোনো নোটই পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নতুন নোটের চাহিদা বেশি
নতুন নোটের চাহিদা বাড়ে ঈদকেন্দ্রিক। ব্যাংক থেকে চাহিদার ভিত্তিতে নতুন নোট ছাড় করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়ে ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ সবাই নেন নতুন টাকা। ঈদ সালামিতেই বেশি কদর বাড়ে এ নোটের। শুধু ঈদ কেন্দ্র করেই নতুন নোট সরবরাহ করা হয় না, মার্কেটে মানি সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেও ছাড়া হয়। গত বছর ঈদের আগেও প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাড়া হয়েছিল বাজারে। তবে ঈদের আগেই এ নোট ছাপা হয় না। নতুন ছাপানো নোট কারেন্সি সার্কুলেশন ও স্টকে জমা থাকে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ছাড়া হয়, এমনটাই বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

যে কারণে নষ্ট হয় নোট
কাগজের নোট নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ ইচ্ছামতো ভাঁজ করা। যেমন- বাসের কন্ডাক্টররা আঙুলের ফাঁকে টাকা ভাঁজ করে রাখেন। আবার অনেকে মাটির ব্যাংক কিংবা গাঁটিতে টাকা রাখেন গুঁটিয়ে। এতে কমে টাকার স্থায়িত্ব। এছাড়া ভেজা হাতে টাকা লেনদেন করা, মুখের লালা লাগিয়ে টাকা গোনা, কলম দিয়ে লেখা প্রভৃতি কারণে টাকা দ্রুত নষ্ট হয়।

রাজধানীর ভিক্টর পরিবহনে নিয়মিত বসুন্ধরা থেকে পল্টনে চলাচল করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আহমেদ। কাগুজে নোটের বিষয়ে আলাপ করতেই তিনি বলেন, আমরা কারণে-অকারণে নোটের ক্ষতি করি। সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় বাস বা হিউম্যানহলার (লেগুনা) হেলপারের ইচ্ছামতো ভাঁজের কারণে। তারা নতুন বা পুরোনো টাকার বড় নোটগুলো ভাঁজ করে আলাদা রাখে। এতেই নোটের ক্ষতি শুরু।

তবে বিষয়টি এড়িয়ে একই বাসের চালকের সহকারী সুমন বলেন, আপনারা বড় নোট দিলে ভাংতির জন্যই ভাঁজ দিয়ে আলাদা করি। অনেক যাত্রীই আমাদের বাছাই করে ছেঁড়া-ফাটা নোট দেন। বারবার গুনতে গিয়েও সেগুলো ছিঁড়ে যায়।

চাইলে কি নোট ছাপানো যায়?
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই টাকা ছাপাবে, সে সুযোগ নেই। এর সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, সেগুলো মেনেই কাজ করতে হয়। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে অর্থনীতির ওপর। বাজারে অর্থের প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে বাড়িয়ে দেবে জীবনযাত্রার খরচ। এ কারণে অর্থনীতির স্বার্থেই ভারসাম্য রাখতে হয়- এমনটাই বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

তবে পুড়িয়ে ফেলা ব্যবহার অযোগ্য নোট ও বাজার সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেই নতুন নোট আনা হয়। অনেক সময় বিশেষ পরিস্থিতিতে টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আবার ছিঁড়ে যাওয়া, পুড়ে নষ্ট হওয়া বা রি-ইস্যু করা যায় না এমন নোটগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলে মার্কেট থেকে তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কয়েক হাজার কোটি টাকা এভাবে তুলে নেওয়া হয়। এ ঘাটতি পূরণেও নতুন নোট সরবরাহের প্রয়োজন পড়ে।

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ফাইন্যান্সিয়াল কারেন্সি ডিপার্টমেন্ট টাকা ছাপায়। তবে কতটুকু ছাপাতে পারবে তা নির্ভর করে রিকয়ারমেন্ট কত আছে কিংবা পুরোনো নোট যখন ইকোনমি এক্সপান্ড করে সেই হিসাবে। তাছাড়া টাকা ছাপাতে হলে ফরেন রিজার্ভ থাকতে হবে, পর্যাপ্ত গোল্ড থাকতে হবে। এমনিতে টাকা ছাপাতে পারে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker