ফুটবল

জিদানের গাড়ি দেখে এমবাপ্পে বলেছিলেন, ‘জুতা খুলে উঠব?’

আমি আপনাদের একটা গল্প বলব।

জেনে নিশ্চয়ই অবাক হবেন না, গল্পটা ফুটবল নিয়ে। আমার সবকিছুই তো ফুটবল ঘিরে।

তিন বছর বয়সে বাবা একটা খেলনা ট্রাক কিনে দিয়েছিলেন। ইলেকট্রিক মোটর লাগানো, আসনে বসে ছোট্ট ট্রাকটা চালানো যায়—এ রকম আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন। আমাদের বাড়ির রাস্তার ওপাশেই ছিল ফুটবল মাঠ। ট্রাক চালিয়ে আমি খেলার মাঠে যেতাম। যেন একজন সত্যিকার ফুটবলার, একটা সত্যিকার ট্রাক চালিয়ে মাঠে প্রশিক্ষণে যাচ্ছে!

কিন্তু একবার মাঠে পৌঁছে গেলেই ট্রাকের প্রতি আমার আর কোনো আগ্রহ থাকত না। বন্ধুরা ঈর্ষান্বিত চোখে আমার বাহনের দিকে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু আমার পুরো মনোযোগ থাকত বলের দিকে। আমার কাছে বলটাই ছিল সব।

হ্যাঁ, এই গল্পটা ফুটবলের। কিন্তু ফুটবলপ্রেমী না হলেও আপনাকে এই গল্পটা বলাই যায়। কারণ, সত্যিকার অর্থে গল্পটা স্বপ্নের। আমাদের বঁদিতে (ফ্রান্সের প্যারিসের উত্তরপূর্ব অংশের একটি শহরতলি) হয়তো খুব বেশি টাকা ছিল না। কিন্তু স্বপ্ন ছিল। হয়তো এ কারণেই যে স্বপ্ন দেখতে টাকা লাগে না।

আমি আর আমার বন্ধুরা ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আমাদের প্রত্যাশা ছিল না, পরিকল্পনা ছিল না, শুধু স্বপ্নটাই ছিল। অনেক শিশুদের ঘরের দেয়ালে সুপারহিরোদের পোস্টার থাকে। আমাদের দেয়ালে ছিল ফুটবলারদের ছবি। জিদান, ক্রিস্টিয়ানোর অনেক পোস্টার আমার কাছে ছিল।

ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম শ্রেণিতে স্কুলে যে ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো, সেটা বিশ্বকাপের চেয়ে কম ছিল না। দুই ইউরোর প্লাস্টিক ট্রফির জন্য আমরা জান দিয়ে লড়তাম। মজার ব্যাপার হলো, নিয়ম ছিল—প্রতিটি দলে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও থাকতে হবে। দুঃখজনকভাবে সব মেয়েরা খেলতে রাজি হতো না। তাই ইনিয়ে–বিনিয়ে তাদের পটাতে হতো। মনে আছে আমার এক বান্ধবীকে বলেছিলাম, সে যদি আমাদের কাপ জিততে সাহায্য করে, আমি তাকে একটা ছবি রং করার বই কিনে দেব।

আমাদের শিক্ষকদের কাছে অবশ্য খেলার তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। তাঁরা শুধু বাড়িতে আমার অপরাধের ফর্দ পাঠাতেন।

‘কিলিয়ান হোমওয়ার্ক করেনি।’

‘কিলিয়ান স্কুলের খাতাপত্র আনতে ভুলে গেছে।’

‘অঙ্ক ক্লাসে কিলিয়ান শুধু ফুটবলের কথা বলে।’

১১ বছর বয়সে কুপে ৯৩–তে (ফ্রান্সের একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট) খেলার অভিজ্ঞতা আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। সেমিফাইনালে আমরা একটা সত্যিকার স্টেডিয়ামে খেলেছিলাম। আমার এখনো মনে আছে, দিনটা ছিল বুধবার। স্টেডিয়ামে এত মানুষের সামনে আগে কখনো খেলিনি। ভয়ে আমি রীতিমতো বলে পা ছোঁয়াতেই পারিনি। ম্যাচ শেষে মা গটগট করে সোজা মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন। আমার কানে ধরে যে কথাটা বলেছিলেন, সেটা আমি কোনো দিন ভুলব না।

মা ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। এ জন্য নয় যে আমি খারাপ খেলেছি। কারণ, আমি ভয়ে ভয়ে খেলেছি। মা বলেছিলেন, ‘যদি হেরেও যাও, সব সময় নিজের ওপর বিশ্বাস রাখবে। তুমি ৬০টা গোল মিস করতে পারো। কিন্তু ভয়ে যদি খেলতেই না পারো, এই ভয় তোমাকে আজীবন তাড়া করবে।’ এরপর আর কখনো কোনো ম্যাচে আমি ভয় পাইনি।

ভিনগ্রহ

আমি যেখান থেকে উঠে এসেছি, সেখান থেকে না এলে আমার কথা বুঝতে হয়তো আপনার একটু অসুবিধা হবে। উদাহরণ দিই। ১১ বছর বয়সে আমি লন্ডনে চেলসির তরুণ দলের সঙ্গে কিছুদিন প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি এতই রোমাঞ্চিত ছিলাম, এতটাই থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম যে প্রতিবেশী বন্ধুদের বলতেও পারিনি যে কোথায় যাচ্ছি। ফিরে আসার পর বন্ধুরা বলল, ‘কিলিয়ান, গত সপ্তাহে কোথায় ছিলে?’

বললাম, ‘লন্ডনে, চেলসির সঙ্গে।’

বন্ধুরা বলল, ‘যাহ, অসম্ভব।’

বললাম, ‘দিব্যি দিয়ে বলছি, সত্যি! এমনকি দ্রগবার সঙ্গেও আমার দেখা হয়েছে।’

ওরা বলল, ‘ধুর, গুল মারার আর জায়গা পাও না! দ্রগবা কেন বঁদির ছেলেদের সঙ্গে দেখা করবে?’

তখন আমার ফোন ছিল না। বাবার ফোন এনে দেখিয়েছিলাম, দ্রগবার সঙ্গে আমার ছবি। তারপর ওরা বিশ্বাস করেছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো, ওদের মনে একটুও ঈর্ষা জাগেনি। একদমই নয়। ওদের চোখে ছিল শুধুই বিস্ময়। ওরা বলছিল, ‘কিলিয়ান, তোমার সঙ্গে কি একদিন আমাদের নিয়ে যাবে?’

যেন আমি একটা অন্য গ্রহে গেছি!

সত্যিই তা–ই। ওসব জায়গায় পৌঁছানো আমাদের কাছে সত্যিই অন্য গ্রহে যাওয়ার মতো ছিল।

জিদানের সঙ্গে দেখা

চেলসির অভিজ্ঞতার পর মা-বাবার কাছে হাত জোড় করে বলেছিলাম, বঁদি ছেড়ে আমি বড় কোনো ক্লাবে চলে যেতে চাই। তাঁরা রাজি হননি। তাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁদের সন্তান ঘরে থেকে একটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করুক। তখন বুঝিনি। কিন্তু এখন বুঝি। ওটাই আমার জন্য ভালো ছিল। বঁদিতে থেকে আমি যেভাবে জীবনের শিক্ষা পেয়েছি, একটা একাডেমির বাবলের ভেতর থেকে সেই শিক্ষা কখনোই পেতাম না।

বাবা ১০ বছর আমার কোচ ছিলেন। এমনকি ক্লেয়ারফন্তেইনের ফ্রেঞ্চ একাডেমিতে খেলতে চলে যাওয়ার পরও ছুটির দিনে বাড়ি ফিরে বাবার এএস বন্ডি দলের সঙ্গে খেলতাম। ফ্রেঞ্চ একাডেমি বিশ্বের অন্যতম সেরা। অথচ বাবার কাছে একাডেমি থেকে শিখে আসা অভিনব কোনো কিছু পাত্তাই পেত না। ক্লেয়ারফন্তেইনের কোচের কথাই আমার মাথায় ঘুরতে থাকত। তিনি সব সময় আমার দুর্বল পা–টাকে সবল করার চেষ্টা করতেন। দক্ষতা বাড়ানোই ছিল মুখ্য। কিন্তু বঁদিতে জেতাটাই ছিল শেষ কথা।

১৪তম জন্মদিনের আগে একটা অবিশ্বাস্য উপহার পেয়েছিলাম। স্পেন থেকে কেউ একজন বাবাকে ফোন করে বলেছিল, তারা ছুটিতে একটা ট্রেনিং সেশনে আমাকে চায়। বাবা রীতিমতো একটা ধাক্কা খেয়েছিলেন। কারণ, তারা বলেছিল, ‘জিদান তোমার ছেলেকে দেখতে চায়।’ সে সময় জিদান ছিলেন স্পোর্টিং ডিরেক্টর। স্বাভাবিকভাবেই এই প্রস্তাব পেয়ে আমি রীতিমতো আকাশে উড়ছিলাম। যেকোনো মূল্যে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু এটা সহজ ছিল না। কারণ, তখন অনেকেই আমাদের খেলা দেখতে আসছিল। আমার খেলা গণমাধ্যমেরও নজর কেড়েছিল। ১৩ বছর বয়সে এসব সামলানো কঠিন। অনেক চাপ ছিল। আমার পরিবার আমাকে এসব থেকে রক্ষা করতে চাইছিল।

কিন্তু আমি জানতাম না, গোপনে মা-বাবা ঠিকই সব বন্দোবস্ত করছিলেন। ১৪তম জন্মদিনে মাদ্রিদে নিয়ে গিয়ে তাঁরা আমাকে চমকে দিতে চেয়েছিলেন।

বিশ্বাস করুন। আমি আমার বন্ধুদের বলিওনি, কোথায় যাচ্ছি। কারণ, শেষ পর্যন্ত যদি সব ঠিকঠাক না হয়, ফিরে এসে আমি ওদের হতাশ করতে চাইনি।

বিমানবন্দর থেকে ট্রেনিং সেন্টারে যাওয়ার মুহূর্তটা আমি কোনো দিন ভুলব না। পার্কিং লটে জিদান তাঁর গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। অবশ্যই ঝাঁ চকচকে একটা গাড়ি। আমি বললাম, ‘হ্যালো’। তিনি গাড়ির সামনের সিটটা দেখিয়ে বললেন, ‘গাড়িতে উঠে পড়ো, চলো’।

আমি বোকার মতো বলে বসলাম, ‘জুতা খুলে উঠব?’

হা হা হা! জানি না এ কথা কেন বলেছিলাম। কিন্তু এটা জিদানের গাড়ি! আমার কথা শুনে তিনি খুব মজা পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আরে নাহ! জলদি ওঠো।’

জিদান আমাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আর আমি ভাবছিলাম, আমি তো বঁদির এক সাধারণ কিশোর কিলিয়ান। আজ আমি জিদানের গাড়িতে! এটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন। আমি নিশ্চয়ই প্লেনে ঘুমিয়ে পড়েছি।

কখনো কখনো বাস্তবতাটাও স্বপ্ন মনে হয়। রাশিয়ার বিশ্বকাপেও আমার একই অনুভূতি হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে মাঠে নামার আগে যখন টানেলে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেই মুহূর্তটা আমি কোনো দিন ভুলব না। উসমান দেম্বেলের দিকে তাকিয়ে আমি হাসছিলাম। বলেছিলাম, ‘ভাবতে পারো? একজন এভরক্সের, আরেকজন বঁদির। আজ আমরা দুজন একসঙ্গে বিশ্বকাপে খেলছি!’

সে বলেছিল, ‘এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য।’

মাঠে নেমেই অনুভব করলাম, সাড়ে ছয় কোটি মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যখন ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত বাজল, চোখে পানি এসে যাচ্ছিল।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker