ফুটবল

মেসির চোখে সুখের কান্না

রবের্তো চেয়াসকে কোথাও দেখা গেল না। আর্জেন্টিনা থেকে তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা জেতার পর আজতেকা স্টেডিয়ামে ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে কাঁধে তুলে ধরেছিলেন চেয়াস। সেই ছবি গোটা পৃথিবীর চেনা। লোকজনের ভিড়ের দঙ্গলে সবার ওপরে দুই হাতে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেছেন ম্যারাডোনা।

লুসাইলেও কাল তেমনই একটি ছবি দেখার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন আর্জেন্টাইনরা। লোকজনের ভিড়ের দঙ্গলে সবার ওপরে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেছেন লিওনেল মেসি। সেই স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হলো। ফুরাল আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের অপেক্ষা। কিংবদন্তি হিসেবে মেসির যে অপূর্ণতাটুকু ছিল, সেটুকুও ঘুচে গেল। আর্জেন্টাইন ফুটবলে ইতিহাসের পাতায় ডিয়েগো ম্যারাডোনার পাশেই উচ্চারিত হবে মেসির নাম।

সর্বকালের সেরা নিয়ে তর্ক থাকলেও সেই তালিকায়ও তাঁর নামটা থাকবে অনেক উঁচুতে। ১৯৮৬ ও ২০২২ যে এখন পাশাপাশি! ’৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা যেভাবে কেঁদেছিলেন, সেভাবেই কাঁদলেন মেসি। কেঁদেছেন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরাও। এই কান্না সুখের, এই কান্না আনন্দের, এই কান্নায় বুকে সুখের ব্যথা বাজে!

আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘টিওয়াইসি স্পোর্টস’কে বলেছেন, ‘অবিশ্বাস্য! এটাই সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। আমি খুব করে (ট্রফি) এটা জিততে চেয়েছি। জানতাম সৃষ্টিকর্তা আমার মনের আশা পূরণ করবেন। এই শিরোপাটা জিতে ক্যারিয়ার শেষ করতে চেয়েছি। এর চেয়ে বেশি কিছু আর চাইতে পারতাম না। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে এই শিরোপা পাইয়ে দিয়েছেন। আমি ফুটবল ভালোবাসি। জাতীয় দলে খেলাটা উপভোগ করি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আরও কয়েকটা ম্যাচ উপভোগ করে যেতে চাই।’

মেসি এই উপভোগের মুহূর্তের দেখা পাওয়ার আগে ফাইনালে তাঁর ভাগ্য নিয়ে বিধাতা কী খেলাটাই না খেললেন! লুসাইলে প্রথমার্ধ শেষেও মেসির হাতে কাপ দেখেছে বিশ্ব। আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল পেনাল্টি থেকে মেসি ও দি মারিয়ার গোলে।

সমতায় ফ্রান্স। তবে কি মেসিকে খালি হাতেই বিদায় নিতে হবে! ম্যাচে ফ্রান্স তখন চাপ বিস্তার করে খেলছে। কিন্তু অলক্ষ্যে কেউ চিত্রনাট্যটাই এমনভাবে লিখেছিলেন যে ম্যাচটা হবে বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে ‘ক্ল্যাসিক’ আর শেষটা হবে আরও নাটকীয়তায়। টাইব্রেকারে! যে এমিলিয়ানো মার্তিনেজ মেসির জন্য জীবন দিতে চেয়েছিলেন, টাইব্রেকারে সেই মার্তিনেজই হয়ে উঠলেন মেসির স্বপ্ন বাঁচানোর ত্রাণকর্তা!

মার্তিনেজকেও ধন্যবাদ দিয়েছেন মেসি। তবে সব ছাপিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে মেসির এই কথা, ‘এই শিরোপাটা জয় যে কারও স্বপ্ন। আমি ভাগ্যবান যে পেরেছি। সব জেতার পর শুধু এটাই বাকি ছিল।’

২০১৪ বিশ্বকাপে সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ফাইনালে মেসির জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন বিধাতা। জার্মানির কাছে হারে কাঁদতে হয়। ব্যাপারটা আরও নির্মম হয়ে দাঁড়ায় পরের বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্সের কাছে হেরে আর্জেন্টিনার বাদ পড়া। বিধাতা কী রসিক, এবার সেই ফ্রান্সের সঙ্গেই আর্জেন্টিনার ফাইনাল! অর্থাৎ বিশ্বকাপ থেকে মেসির বিদায়ী ম্যাচে এর চেয়ে ভালো মঞ্চ আর হতে পারত না—দল ফাইনালে, প্রতিপক্ষ সেই ফ্রান্স আর তাদের হারিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার দারুণ সুযোগ। তার চেয়েও বড় কথা, প্রশ্ন ছিল, বিশ্বকাপে নিজের শেষ ম্যাচে মেসি আর্জেন্টিনার অধরা স্বপ্নটা পূরণ করতে পারবেন কি না? উত্তরটা সবাই জানেন।

সবাই আরও জানেন, পারফরম্যান্সে ’৮৬-এর ম্যারাডোনার চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই মেসি। ’৮৬ বিশ্বকাপে ৫ গোল ও ৫টি ‘অ্যাসিস্ট’ করেছিলেন ম্যারাডোনা। মেসি এবার করলেন ৭ গোল ও বানিয়েছেন আরও ৩ গোল। অর্থাৎ গোল করা ও করানো মিলিয়ে মেসি ও ম্যারাডোনা সমান। ’৮৬-তে ম্যারাডোনার মতোই এবার গোল্ডেন বলও উঠেছে মেসির হাতে। কিন্তু বিশ্বকাপ থেকে মেসির মতো বিদায় শুধু ম্যারাডোনা কেন, আর কারও ভাগ্যেও কি জুটেছে?

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker