ক্রিকেট

অবমাননায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে দিলেন তামিম

‘জেন্টলম্যান, আই হ্যাভ অলরেডি প্লেইড মাই লাস্ট ম্যাচ’―তামিম ইকবালের মুখ থেকে উচ্চারিত কাল্পনিক এই ঘোষণা শোনার পর অনানুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের প্রতিক্রিয়া ঢাকায় বসেও আঁচ করতে পারছি। বাংলাদেশ দল কিংবা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া বোঝা দায়। কারণ ড্রেসিংরুম এবং বিসিবির বোর্ডরুমের আবহাওয়া ইংল্যান্ডের গ্রীষ্মের মতো, কখন রোদ উঠবে আর বৃষ্টি নামবে―কেউ আঁচ করতে পারে না! ঘটনাক্রমে মনে হতে পারে, আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের দিন একটি বাংলা দৈনিকে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানের মন্তব্যের আঘাতে জর্জরিত হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তামিম ইকবাল। কিন্তু মোটেও তা নয়।

১৬ বছর দাপটে ক্রিকেট খেলেছেন। বাংলাদেশের জার্সিতে তামিমের গড়া সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক রানের রেকর্ড আরো কয়েক বছর নিশ্চিতভাবেই টিকে থাকবে। এই সুনামের সূত্র ধরে বিস্তর উপার্জন করেছেন। তার ওপর স্ত্রী ও দুই সন্তানের সুখী পরিবারের গর্বিত পিতা তামিমের ব্যক্তিত্বকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যেখানে আরেকটি বিশ্বকাপের ‘লোভ’ করা নীচতা মাত্র!

‘আমি চাইলে অন্তত বিশ্বকাপ পর্যন্ত তো খেলতে পারতাম।

কিন্তু আমি এই জীবনে যা করেছি, জীবনকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাতে আরেকটি বিশ্বকাপের জন্য এত বড় বিসর্জন দেওয়ার কোনো মানে নেই’, বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে যতিচিহ্ন টানার ঘোষণার সময় টেলিফোনের ওপারে খুব বেশি ভারাক্রান্ত মনে হয়নি তামিমকে। ‘হ্যাঁ, একটু খারাপ তো লাগছেই। যে কারোরই লাগবে। কম দিন তো আর ক্রিকেট খেলিনি।

রান, ম্যাচ, দলের জয়, হারের কষ্ট, টিম মেট, সমর্থক, মিডিয়া―কী অসাধারণ জার্নি আচমকা থামিয়ে দিচ্ছি… মন অবশ্যই খারাপ। তবে সেটার চেয়ে বেশি আছে রিলিভ।’ যদিও এই ‘রিলিভ’ কিসের কারণে, সেটি এড়িয়ে গেছেন তামিম। তবু প্রশ্ন জুড়ে দিলাম, ‘বোর্ড সভাপতির বক্তব্যই কী কারণ?’ “সে রকম না। এমন তো আগেও হয়েছে।

উনি বলেছেন সেদিন। এটা বড়জোর ‘আইসিং অন দ্য কেক’ বলতে পারেন। কিন্তু আমার পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে আরো আগে। তিন-চার দিন তো হবেই। ওরা বুঝতে পারছিল যে আমি ভালো বোধ করছি না। কেন ভালো বোধ করছিলাম না, সে প্রশ্ন করবেন না।”

তামিম ইকবালের ভালো বোধ না করার কারণও আছে। বিশেষ করে ওয়ানডে দলের অধিনায়ক হিসেবে তিনি কখনোই নিজেকে স্বস্তির জায়গায় দেখেননি। ক্রিকেটে অধিনায়ক মানে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বাংলাদেশের অন্য দশজন অধিনায়কের মতো তাঁকেও এই ক্ষমতার ভাগাভাগিতে পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। বরং নানা সময়ে সংবাদমাধ্যমে ‘সরল মনে’ বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা এমন সব মন্তব্য করেছেন, যেকোনো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের জন্য সেসব অবমাননাকর। নানা সময়ে তামিমের কাছ থেকে অধিনায়কত্ব অন্য কাউকে দেওয়ার আলোচনাও হয়েছে। তামিম ইকবাল কিংবা সাকিব আল হাসানরা বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন পরাশক্তি যে সেসব ফিসফাস ঠিকই পৌঁছে যায় তাঁদের কাছে। তামিমও জেনেছেন, তিনি স্বেচ্ছায় অধিনায়কত্ব ছাড়লে বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বোর্ডের বৃহৎ একটি অংশ! তাতে তামিমের নিজেকে ‘আনওয়ান্টেড’ মনে হয়েছে। সেটা বুদ্ধিসম্পন্ন যে কারোরই মনে হওয়ার কথা। সঙ্গে যদি ব্যক্তিত্বের ভার থাকে, তবে তিনি জায়গা ছেড়ে দেবেনই। তামিম ইকবাল আরেক পা এগিয়ে অধিনায়কত্বের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই স্বেচ্ছা নির্বাসন নিলেন।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের রাতেই তামিম ইকবাল ব্যক্তিগতভাবে সংবাদকর্মীদের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি জানিয়েছেন। খবরটি চাউর হতেই বোর্ডের পক্ষ থেকে তামিম ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ দুটোই ‘আনরিচেবল মোড’ করে রাখেন তিনি। কারণ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন তামিম। তাই এ নিয়ে কোনো অনুরোধ কিংবা পরামর্শ শোনার ইচ্ছা তাঁর নেই।

এতটুকু লেখার পরও বিশ্বাস হচ্ছে না, আর কটা দিন পরের বিশ্বকাপ নিজের ‘উইশলিস্ট’ থেকে অনায়াসে বাদ দিচ্ছেন তিনি! যতটুকু জানতাম, বিশ্বকাপের পর ঘরের মাঠে কোনো সিরিজ খেলে ওয়ানডে ছেড়ে আরো কিছুদিন টেস্ট ক্রিকেট খেলবেন তামিম। টি-টোয়েন্টি তো আগেই ছেড়েছেন। এত রূপকল্প এভাবে ফেলে যাচ্ছেন কেন?

শেষ প্রচেষ্টায় সফল হলাম। উত্তর দিলেন তামিম ইকবাল, ‘ধরুন আমি আপনাকে একটা জিনিস দিলাম। কিন্তু দেওয়ার পর থেকেই চিন্তায় আছি সেটা কিভাবে ফেরত নিয়ে আরেকজনকে দেওয়া যায়। সেটা আবার আপনিও বুঝতে পারছেন। তাহলে কি আপনি সেটা রাখবেন? সেটা রেখে দেওয়া কি আপনার জন্য সম্মানজনক হবে?’

সেই ‘জিনিস’ মানে, অধিনায়কত্ব তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই ছেড়ে দিলেন তামিম ইকবাল খান। তবে ৭০ টেস্ট, ২৪১ ওয়ানডে আর ৭৮ টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ১৫২০৫ রান তাঁর ক্যারিয়ারের আলো জ্বালিয়ে রাখবে ঠিকই।

ধন্যবাদ তামিম ইকবাল, দেশের জার্সিতে আপনার অনন্য অবদানের জন্য।

অভিনন্দন তামিম ইকবাল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনের শেষ দিনটিতেও ব্যক্তিত্বের বাতি জ্বালিয়ে রাখার জন্য। আনন্দময় হোক আপনার আগামীর পথচলা।


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts to your email.

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker