ক্রিকেট

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২২: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ যে সম্পদ বাংলাদেশের একজনও নেই

বর্তমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ী দল অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ মনে করেন, স্পিন বোলারদের কারণেই দুবাইয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জয় পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।

অ্যাডাম জাম্পা অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার ওই টুর্নামেন্টে সাত ম্যাচ বল করে ১৩টি উইকেট নিয়েছিলেন।

তিনি ছিলেন বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার।

যদিও অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে চলমান বিশ্বকাপের ভেন্যুগুলো ফাস্ট বোলারদের বাউন্স ও সুইংয়ের জন্য বিখ্যাত, তবু ফিঞ্চ বিশ্বাস করেন এবারও স্পিনারদের ভূমিকা থাকবে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার বলেন, “অস্ট্রেলিয়ার বড় মাঠগুলোতে, বিশেষত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে স্পিন প্রভাব ফেলবেই।”

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের বর্তমান টি-টোয়েন্টি বোলারদের র‍্যাংকিংয়ের সেরা দশ বোলারদের মধ্যে পাঁচজনই রিস্ট বা লেগ স্পিনার।

চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম হ্যাটট্রিকও করেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের লেগ স্পিনার কার্তিক মেইয়াপান।

জনপ্রিয় ক্রিকেট উপস্থাপক এবং ভারতের সাবেক ক্রিকেটার আকাশ চোপড়া, তার একটি কলামে লিখেছিলেন, ‘আইপিএল- এর এল মানে অনেকেই বলেন লেগস্পিনার’।

বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে লেগস্পিনাররা এখন অ্যাসেট।

আকাশ চোপড়ার মতে, তিনটি কারণে লেগস্পিনাররা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন ব্যাটসম্যানদের জন্য।

ব্যাটসম্যানদের কমফোর্ট জোনের বাইরে নিয়ে আসা

ছোট ফরম্যাট, মাত্র ১২০ বলের খেলা এখানে প্রচুর ছক্কা মারার চেষ্টা করেন ব্যাটসম্যানরা।
স্পিনারদের বিপক্ষে যা আরও কঠিন।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিচের হাতের জোরটা বেশি কাজ করে এবং ব্যাটসম্যানরা স্বভাবতই লেগ সাইডে মারার চেষ্টা করেন।
২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৬৫% ছক্কা মারা হয়েছে ব্যাটসম্যানের লেগ সাইডে বা অন সাইডে।
এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ান লেগস্পিনাররা, কারণ একজন লেগস্পিনার ব্যাটসম্যান থেকে বল দূরে নিয়ে যান।
তখন ডান হাতি বা বাহাতি ব্যাটসম্যান নতুন উপায় খোঁজেন রান পাওয়ার জন্য।
অনেক অধিনায়ক এখন বাঁ হাতি স্পিনারদের, বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান থাকলে বল হাতে দেন না, কিন্তু একজন লেগস্পিনার থাকলে এই ব্যাপারে ভাবতে হয় না।

ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ, টি-টোয়েন্টি র‍্যাংকিংয়ের আট নম্বরে আছেন
ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ, টি-টোয়েন্টি র‍্যাংকিংয়ের আট নম্বরে আছেন

বল নিচু হয়ে আসা

লেগস্পিনাররা দ্রুতবেগে এসে বল ছোঁড়েন একটু নিচু হয়ে, অফস্পিনারদের চেয়ে যা একটু আলাদা।
হরভজন সিং বা মঈন আলীর মতো অফস্পিনাররা যেখান থেকে বল ছোড়েন, রশিদ খান বা আফ্রিদি আরও নিচে থেকে বল ছোড়েন, আর চাপটা থাকে বলের ওপর, তাই স্বভাবতই বল টার্ন করুক আর না করুক সেটা নিচু হয়ে আসে।
নিচু হয়ে আসা বল মারা সবসময়ই কঠিন।

ব্যাটসম্যান টার্ন বুঝতে না পারা

এই দিক থেকে রশিদ খানের বল বিশেষ।
তিনি জোরের ওপর বল ছোড়েন, তার বল বাতাসে দ্রুত ভেসে আসে উইকেটে পিচ করার পর ব্যাটসম্যানকে দ্বিধায় থাকতে হয়।
এ কারণে রশিদ খান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সফলতম বোলারদের একজন।
আগে দেখা যেত ব্যাটসম্যান চেষ্টা করতেন বল টার্ন করার আগেই সামনে এসে মারার, কিন্তু এখন বল ছোড়ার সাথে সাথে ব্যাকফুটে চলে যান, কারণ তিনি জানেন না বল কোনদিকে টার্ন করবে।
এতে করে ব্যাটসম্যানের মনে যে অস্পষ্টতা তৈরি হয় সেটা ফুটে ওঠে ফলাফলেও।

রশিদ খান, মেলবোর্ন
রশিদ খানের মতো বোলারদের জন্য এই মাঠ হতে পারে সবচেয়ে ভালো জায়গা।

আগের বিশ্বকাপে লেগস্পিনাররা কেমন করেছেন

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০০৭ এ লেগ স্পিনার শহীদ আফ্রিদি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ছিলেন যৌথভাবে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০০৯ এ আফ্রিদি ছিলেন তৃতীয়, সেই বিশ্বকাপে আফ্রিদি সাত ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়েছিলেন, ওভারপ্রতি ছয়েরও কম রান দিয়ে।
এই দুটি বিশ্বকাপে পাকিস্তান ফাইনাল খেলেছিল, একবার রানার আপ, আরেকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১০ এ যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ছিলেন স্টিভ স্মিথ, যিনি পরবর্তীতে পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হয়ে যান।
সাত ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়েছিলেন, এক যুগ আগের লেগ স্পিনার স্মিথ।
তার পরের বিশ্বকাপে ২০১২ সালে অবশ্য লেগস্পিনাররা তেমন ভালো করতে পারেননি।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৪ এর সেরা পাঁচ উইকেট শিকারী বোলারদের মধ্যে তিনজন ছিলেন লেগস্পিনার, দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির, ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্যামুয়েল বদ্রী এবং ভারতের অমিত মিশরা।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬ এর শীর্ষ পাঁচ বোলারের চারজনই ছিলেন স্পিনার, যার মধ্যে দুজন ছিলেন লেগস্পিনার, রশিদ খান ও ইশ সোধী।
আর গত বছর হয়ে যাওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শীর্ষ দুই বোলারই লেগস্পিনার শ্রীলঙ্কার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা ও অস্ট্রেয়িলার অ্যাডাম জাম্পা।

দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন তাবরাইজ শামসি, যিনি বা হাতে লেগ স্পিন করেন
দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন তাবরাইজ শামসি, যিনি বা হাতে লেগ স্পিন করেন, তাকে রিস্ট স্পিনারও বলা হয়
এই বিশ্বকাপে যেসব লেগস্পিনার
টি-টোয়েন্টি র‍্যাংকিংয়ের দুই নম্বরে থাকা লেগস্পিনার রশিদ খানের দিকে থাকবে নজর, তিনি অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগের সফলতম ক্রিকেটারদের একজন।
এই ধরনের মাঠে কীভাবে বল করতে হয় সে বিষয়ে রশিদ খানের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে।
শ্রীলঙ্কার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা, যিনি গত বিশ্বকাপেও শীর্ষ উইকেট শিকারী বোলার ছিলেন, হাসারাঙ্গা ও রশিদ খান দুজনই ব্যাট হাতেও ভূমিকা রাখতে পারেন।
এমন আরেকজন ক্রিকেটার পাকিস্তানের শাদাব খান, তিনিও ব্যাট ও বল হাতে লেগস্পিন দিয়ে পাকিস্তানের জয়ে ভূমিকা রেখে আসছেন।
ভারতের ইয়ুজভেন্দ্র চাহাল আছেন, যদিও তিনি টি-টোয়েন্টির এই বিশ্ব আসরে তেমন সফল নন, তবুও এই টুর্নামেন্টে তার ওপর ভরসা করতে হবে ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে।
ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ, টি-টোয়েন্টি র‍্যাংকিংয়ের আট নম্বরে আছেন, তিনি ইংল্যান্ডের এই স্কোয়াডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের একজন।
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম জাম্পা আছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন তাবরাইজ শামসি, যিনি বা হাতে লেগ স্পিন করেন, তাকে রিস্ট স্পিনারও বলা হয়।
নিউজিল্যান্ডের ইশ সোধী খুব একটা আলোচিত নন কিন্তু টি-টোয়েন্টির সেরা স্পিনারদের একজন তিনি।
বর্তমানে নিউজিল্যান্ড দলেরও গত এক বছরে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী সোধী।
এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে কোনও লেগস্পিনার নেই
জুবায়ের লিখন

জুবায়ের লিখন (মাঝে) যিনি বাংলাদেশের হয়ে ছয়টি টেস্ট, তিনটি ওয়ানডে ও একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন

বাংলাদেশে কোনও কালেই কোনও লেগস্পিনার প্রতিষ্ঠিত হননি

কখনো অলক কাপালি, মোহাম্মদ আশরাফুলরা টুকটাক বল করেছেন, কিন্তু তারা কেউই ফুলটাইম বোলার নন।

এরপর জুবায়ের হোসেন লিখন, আমিনুল বিপ্লবরাও জাতীয় দলে টুকটাক খেলেছেন, তারা বেশিদিন জাতীয় দলে টেকেননি বা তাদের ওপর ভরসা রাখা হয়নি।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ২০২০ সালে এমন নিয়মও করে দেয়া হয়েছিল প্রতি দলে অন্তত একজন লেগস্পিনার রাখতে হবে।

কিন্তু তারপরও লেগস্পিন দিয়ে জাতীয় দলে কেউ পা রাখতে পারেননি।

বাংলাদেশে যেমন লেগস্পিনার নেই, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা লেগস্পিন ভালো খেলতেও পারেননা।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ খেলতে এসে এই সমস্যার দিকটা নিয়ে কথা বলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক ফ্যাফ ডু প্লেসি।

বাংলাদেশের শীর্ষ ক্লাব আবাহনী এবং বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাথে নিয়মিত কাজ করেন খালেদ মাহমুদ সুজন, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের সময় তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল বাংলাদেশে লেগস্পিনার উঠে না আসার কারণ কী?

তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “লিগে লেগস্পিনার খেলানো বাধ্যতামূলক করতে হবে।”

কিন্তু বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে যথেষ্ট লেগস্পিনার নেই, যে কারণে বাধ্যতামূলক করেও নিয়ম শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা যায়নি।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker