ইতিহাস ও ঐতিহ্যজাতীয়

টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প ধ্বংসের মুখে

আব্দুস সাত্তার:
টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ধ্বংসের মুখে পড়েছে। করোনার প্রথম ঢেউ ও গেল বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় লাগাতার লকডাউনের প্রভাবে টাঙ্গাইলের তাঁতিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তাদের বাপ-দাদার পেশাকে ধরে রাখতে গিয়ে অধিকাংশ তাঁতীর পথে বসার উপক্রম হয়েছে। কিছু কিছু তাঁতী তাদের বাপ-দাদার পেশাকে ছেড়ে দিয়ে অটোভ্যান, রিক্সা ও সবজির ব্যবসা করে লকডাউন সময়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন।
করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ের প্রভাব ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক তাঁতিদের একটি বৃহৎ অংশ জীবিকার প্রয়োজনে বাপ-দাদার পেশা বদলাতে গিয়েও খাপ খাইয়ে নিতে না পারায় কার্যত: বেকার হয়ে পড়েছেন। এ শিল্প রক্ষায় সরকারি প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও তা কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড(বাতাঁবো) কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষুদ্রঋণও স্থানীয় তাঁতিদের মাঝে পর্যাপ্ত হার ও সংখ্যায় বিতরণ করা হয়নি। কোন রকম সরকারি সহায়তা না পাওয়ার ফলে এর প্রভাব পুরো তাঁতশিল্পের উপর পড়েছে।
টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা জানায়, শাড়ি ব্যবসার জন্য পয়লা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ও দুর্গাপুজা প্রধান মৌসুম। এবার পয়লা বৈশাখ(১৪ এপ্রিল) থেকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এবছর পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে করোনার প্রথম ঢেউ ও বন্যার পর কোন কোন তাঁত ফ্যাক্টরী মালিক ঘরে মজুদ থাকা শাড়ি কম দামে পাইকারী বিক্রি করে এবং তাঁত(১০টির মধ্যে ২-৩টি) বিক্রির টাকায় শাড়ি তৈরি করেছেন। অনেক তাঁতি গত বছরের পয়লা বৈশাখের উৎসবের জন্য যেসব শাড়ি তৈরি করেছিল অথচ করোনার কারণে বিক্রি হয়নি সেগুলো মজুদ করে রেখেছিল। এবারও সেগুলো বিক্রি হচ্ছেনা। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার জন্য নতুন শাড়ি বানানো বা চাহিদা নিরূপন করা হয়নি। ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে দামি শাড়ি তৈরি ও বেশি শাড়ি বিক্রি হয়।
গত বছর বৈশাখে শাড়ি তৈরিতে ১০৭ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। শাড়ি বিক্রি না হওয়ায় সেগুলো মজুদ রয়েছে। এ বছর ১১০ কোটি টাকার শাড়ি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে তা পূরণ হয়নি। আগামি ঈদুল ফিতরে শাড়ি উৎপাদনে কোন লক্ষ্যমাত্রাই নির্ধারণ করা হয়নি। একই অবস্থা ছিল ঈদুল আযহায়। আগামি দুর্গাপুজায়ও একই অবস্থা বিরাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই করোনা পরিস্থিতি না দেখে তাঁত মালিকরা আগাম কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। ফলে ছোট তাঁত মালিকদের কেউ কেউ পৈত্রিক পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় গিয়েও তেমন সুবিধা করতে না পেরে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
তাঁতিদের ধারণা, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় লাভ-লোকসান তো পরের হিসাব এ শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা হবে কিনা তা নিয়েই তারা শঙ্কিত।
বাতাঁবো সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য জেলার কালিহাতীর বল্লায় (ঘাটাইল, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার জন্য একটি এবং সদর উপজেলার বাজিতপুরে দেলদুয়ার, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখীপুর ও সদর উপজেলার জন্য একটি) বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের দুইটি বেসিক সেণ্টার রয়েছে।
বাতাঁবো’র বাজিতপুর ও বল্লা এ দুইটি বেসিক সেণ্টারের নিয়ন্ত্রণে ৪৯টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি এবং ৪টি মাধ্যমিক তাঁতি সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির চার হাজার ৩৯১টি তাঁত ফ্যাক্টরি মালিকের ২৭ হাজার ৯৩১টি তাঁত চালু বা সচল এবং দুই হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ বা অচালু রয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে সরকারি নির্দেশনায় কল-কারখানা-ফ্যাক্টরি বন্ধ ঘোষণা করায় চালু তাঁত ফ্যাক্টরিগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জেলার তাঁতশিল্পে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৮৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০টাকা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়। সে সময় করোনা মহামারির সঙ্গে বন্যার করাল থাবা জেলার তাঁতশিল্পকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। করোনায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরিতে তাঁত মালিকদের বিনিয়োগ বিনষ্ট হচ্ছিল। এর সঙ্গে বন্যার পানি এসে ফ্যাক্টরিতে চালু তাঁত, তাঁতে থাকা সুতার ভিম, কাপড় ও সরঞ্জামাদী প্রায় সবই বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁতশিল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ এসে সেখানেও কঠোর ধাক্কা দিচ্ছে। ফলে ‘নদী চর খাল বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’ প্রবাদটি টাঙ্গাইলের পরিচিতির সঙ্গে আর প্রযোজ্য না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাতাঁবো’র টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাজিতপুর বেসিক সেণ্টার সূত্রে জানা যায়, এ সেণ্টারের ৩২টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি ও তিনটি মাধ্যমিক সমিতির দুই হাজার ২৬৭ তাঁত মালিকের মোট ১২ হাজার ৪২৯টি তাঁত রয়েছে।
এরমধ্যে দুই হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ বা অচালু এবং ৯ হাজার ৭৫৬টি তাঁত চালু ছিল। মূলত: এ বেসিক সেণ্টারের তাঁতগুলোতে মিহি সুতার ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি হয়ে থাকে।
বল্লা(কালিহাতী) বেসিক সেণ্টারের সূত্রমতে, এ সেণ্টারের ১৭টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি ও একটি মাধ্যমিক তাঁতি সমিতির অধীনে দুই হাজার ১২৪টি তাঁত ফ্যাক্টরি মালিকের ১৮ হাজার ১৭৫টি তাঁত রয়েছে। এ বেসিক সেণ্টারের তাঁতগুলোতে অপেক্ষাকৃত মোটা সুতার শাড়ি উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাতাঁবো’র বেসিক সেণ্টারের সমিতির তালিকার বাইরেও অনেক তাঁত ও তাঁত মালিক রয়েছে।
টাঙ্গাইলের তাঁত মালিক, শ্রমিক, বেসিক সেণ্টারের কর্মকর্তা সহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, করোনা মহামারির প্রথম ঢেউয়ের সাথে বন্যার দুর্যোগ যোগ হয়ে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পকে এক প্রকার পঙ্গু করে দিয়েছে। এরমধ্যে আবার করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এসে এ শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় মহাসঙ্কট তৈরি করেছে।
টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী পাথরাইলের শাড়ি প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ী নীল কমল বসাক জানান, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সঙ্গে বন্যা তাঁত শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এ শিল্প টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি তাঁত শাড়ির বাজার তৈরিতেও সরকারের ভূমিকা প্রত্যাশা করেন তিনি।
টাঙ্গাইল জেলা তাঁতি লীগের সহ-সভাপতি কাঁলাচাঁদ বসাক জানান, করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি পুরোপুরি অস্তিত্বের মহাসঙ্কটে পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ শিল্প আদৌ থাকবে কি-না সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শর্তহীন সুদমুক্ত ঋণ ও সরকারি প্রণোদনা ছাড়া তাঁতিরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেনা।
টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং এর মালিক রঘুনাথ বসাক জানান, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সাথে বন্যা এবং প্রায় একই সঙ্গে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহ দুর্যোগে জেলার তাঁত শিল্পে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় দুই লাখ পরিবার এক প্রকার কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদের জীবন-জীবিকার উপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় শর্তহীন সুদমুক্ত ঋণ ও প্রণোদনার পাশাপাশি সরকারের কাছে পাঁচদফা সুপারিশনামা উপস্থাপন করেন তিনি।
সুপারিশগুলো হচ্ছে- শাড়ির নতুন নতুন বাজার তৈরি করা, শর্তহীন সুদমুক্ত ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা, বিদেশ থেকে শাড়ি আমদানী বন্ধ করা, দেশি পণ্য বিশেষ করে সালোয়ার-কামিজের পরিবর্তে শাড়ি ব্যবহারে উৎসাহিত করা, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিণ্ট মিডিয়ায় দেশীয় শাড়ি ব্যবহারে জনমত তৈরি করা ইত্যাদি।
টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মোফাখখারুল ইসলাম জানান, করোনা মহামারি জেলার তাঁতশিল্পকে অস্তিত্বের মহাসঙ্কটে ফেলেছে। তাঁত মালিক ও এর সাথে জড়িত প্রায় দুই লাখ মানুষ কর্মহীন অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যারা এক সময় দান-অনুদান বিতরণ করেছে- তারাও এখন নিজেদের পরিবারের মৌলিক চাহিদা পুরণ করতে পারছেনা। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সাথে গেল বন্যার সময় থেকে তাঁতিদের উৎপাদিত পণ্য ঘরে থেকে বিনষ্ট হচ্ছে- কোথাও বিক্রি হচ্ছেনা। শর্তহীন সুদমুক্ত ঋণ ও সরাসরি সরকারি প্রণোদনা ব্যতিত এ সঙ্কট থেকে তাঁতিদের উত্তরণের পথ নেই।
টাঙ্গাইল সদরের বাজিতপুর বেসিক সেণ্টারের লিয়াজোঁ অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, তারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ১৩৮জন তাঁতিকে মাত্র ৫% সার্ভিস চার্জে ঋণ দিয়েছেন। আরও ৭৪ জনের ঋণ প্রস্তাবনা প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে। শাড়ি উৎপাদন ও বাজারজাত করণ কিংবা নতুন বাজার সৃষ্টিতে তাঁতিদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি জানান, মূলত: করোনা মহামারির শুরু থেকে তাঁতশিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে। এরমধ্যে গেল বন্যায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ তাঁতশিল্পকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে। করোনা পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ শিল্প মহাসঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

Author


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker