ইতিহাস ও ঐতিহ্য

বায়োস্কোপ: গ্রাম বাংলার চলমান ছবির জাদুর বাক্স

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া বায়োস্কোপ, যা একসময় ছিল গ্রাম বাংলার শিশু-কিশোরদের প্রধান বিনোদনের মাধ্যম এবং চলচ্চিত্রের অগ্রদূত।

বায়োস্কোপ শুধু একটি বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, এটি ছিল চলমান ছবির এক জাদুর বাক্স। টিনের বা কাঠের তৈরি একটি বাক্সে কয়েকটি ছোট গোলাকার ছিদ্র থাকত, যেখানে চোখ রেখে দর্শকরা ভেতরের ছবি দেখতে পেত। বায়োস্কোপওয়ালা কাঁধে এই বাক্স নিয়ে গ্রামের পথে পথে ঘুরতেন।

হ্যাঁ, ‘কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া বায়োস্কোপ’- এই কথাটি আমাদের লোকজ সংস্কৃতির এক গভীর আবেগের জন্ম দেয়। একসময় গ্রামবাংলার শিশু-কিশোরদের প্রধান বিনোদন মাধ্যম ছিল এই বায়োস্কোপ, যা আধুনিক প্রযুক্তির যুগে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

যেভাবে বায়োস্কোপ কাজ করত

বায়োস্কোপ মূলত ছিল চলমান স্থিরচিত্রের এক প্রদর্শনী। বাক্সের ভেতরে একটি রিলের মধ্যে বিভিন্ন স্থিরচিত্র সাজানো থাকত। বায়োস্কোপওয়ালা হাতে একটি ডুগডুগি বা খঞ্জনি বাজিয়ে সুর করে ছবির বর্ণনা দিতেন এবং একই সাথে বাক্সের হাতল ঘুরিয়ে ছবিগুলো পরিবর্তন করতেন।

দর্শকদের জন্য এটি ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। তারা দেখত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, ঐতিহাসিক ঘটনা, রাজা-বাদশাহর গল্প বা জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকার ছবি। বায়োস্কোপওয়ালার ছন্দময় ধারা বর্ণনার সঙ্গে ছবি দেখার এই অভিজ্ঞতা দর্শকদের এক অজানা কল্পনার জগতে নিয়ে যেত।

বায়োস্কোপের আগমন

বঙ্গভঙ্গেরও আগে বাংলায় বায়োস্কোপকে ‘টকি’ বা ‘টগি’ নামেও ডাকা হত। ১৮৯৬ সালে স্টিফেন্স নামক এক বিদেশি কলকাতায় প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শন করেন, যা ছিল বিদেশি চিত্র দিয়ে সজ্জিত। স্টিফেন্সের এই প্রদর্শনীই মানিকগঞ্জের হীরালাল সেনকে অনুপ্রাণিত করে। ১৮৯৮ সালে হীরালাল সেন ‘দ্য রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাণিজ্যিকভাবে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করেন। হীরালাল সেনকে বাংলায় চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে গন্য করা হয়।

বায়োস্কোপের স্বর্ণযুগ ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

হীরালাল সেন প্রাথমিকভাবে বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য, নদী, গঙ্গার ঘাট এবং মন্দিরগুলোর চিত্র সংগ্রহ করে বায়োস্কোপে দেখাতেন। এরপর তিনি ‘ক্লাসিক’ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাটক, নাচ, এবং গান রেকর্ড করে সেগুলো বায়োস্কোপের মাধ্যমে প্রদর্শন করা শুরু করেন। এখান থেকেই মূলত বাংলায় চলচ্চিত্রের সূচনা হয়। কিন্তু হীরালালের বায়োস্কোপ কোম্পানি শেষ পর্যন্ত টেকে নি। তবে ততদিনে বায়োস্কোপ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার গ্রামে গঞ্জে, মেলায় তখন দেখা মিলতো বায়োস্কোপের। মানুষ দলে দলে ভিড় জমাতে বায়োস্কোপের চিত্র আর সুরের যাদুতে নানা বিষয়ে জানার জন্য। বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু করে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের গল্পও বায়োস্কোপের হাত ধরে মানুষের কাছে, নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছেছে বলা যায়।

কালের বিবর্তনে বায়োস্কোপের বিলুপ্তি

৭০-এর দশক পর্যন্ত বায়োস্কোপ গ্রাম এবং শহরে বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাব, বিশেষ করে টেলিভিশন, কম্পিউটার, ভিসিআর, এবং পরে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে বায়োস্কোপ তার আবেদন হারায়। এখনকার প্রজন্ম উচ্চ রেজুলেশনের ভিডিও দেখে অভ্যস্ত, তাই স্থিরচিত্রের বায়োস্কোপ তাদের কাছে সেভাবে আগ্রহ সৃষ্টি করে না। ফলে বায়োস্কোপওয়ালাদের পেশা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক সময়কার জমজমাট এই শিল্প এখন শুধু ইতিহাস।

ঐতিহ্যবাহী বায়োস্কোপের বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে বায়োস্কোপ খুবই কদাচিৎ দেখা যায়। এটি এখন মূলত লোকশিল্প মেলা, জাদুঘর বা ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলোতে স্থান পায়, যেখানে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে এই বিলুপ্ত প্রায় ঐতিহ্যের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। কিছু শিল্পী এখনো এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম। বায়োস্কোপ আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, এটি ছিল গল্প বলা এবং ছবি দেখানোর একটি অনন্য পদ্ধতি যা মানুষের জীবনে আনন্দ নিয়ে আসত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি হারিয়ে গেলেও, এটি আমাদের স্মৃতির পাতায় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker