স্বাস্থ্য

সজিনার আশ্চর্য গুণাগুণ জেনে নিন

বাড়ির আঙ্গিনায় পতিত ভিটায় কিংবা বাগানে সজিনার নরম শরিলীয় গাছ যেন পরিবেশের শ্রী বৃদ্ধিতে অনবদ্য। সজনে গাছের পাতাকে বলা হয় অলৌকিক পাতা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিকর হারবাল। গবেষকরা সজনে পাতাকে বলে থাকেন, নিউট্রিশন্স সুপার ফুড এবং সজনে গাছকে বলা হয় মিরাক্কেল ট্রি।

কিশোরগঞ্জের তেরটি উপজেলার সর্বত্রই জন্মে সজিনা গাছ। বাজারে সজিনার চাহিদাও ব্যাপক; দামও আকাশচুম্বী। দেশি-বিদেশি পুষ্টি বিজ্ঞানীরা সজিনাকে অত্যাশ্চর্য বৃক্ষ বা অলৌকিক বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এর পাতায় আট রকম অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডসহ ৩৮% আমিষ আছে যা বহু উদ্ভিদেই নেই। সজিনা সবজির চেয়ে এর পাতার উপকার আরও বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকায় এ গাছকে মায়েদের ‘উত্তম বন্ধু’ এবং পুষ্টির এক অনন্য সহজলভ্য উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) মতে, বিজ্ঞানীরা পুষ্টির দিক দিয়ে সজিনাকে ‘পুষ্টির ডিনামাইট’ আখ্যায়িত করে বলেন, এ গাছটি থেকে পুষ্টি, ঔষধিগুণ ও সারা বছর ফলন পাওয়া যায় বিধায় বাড়ির আঙিনায় এটি একটি ‘মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ’ এর পুষ্টিগুণ খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্য শক্তি কিলোক্যালরি ৪৩, পানি ৮৫.২ গ্রাম, আমিষ ২.৯ (গ্রাম), চর্বি  ০.২ (গ্রাম), শর্করা ৫.১ (গ্রাম), খাদ্য আঁশ ৪.৮ (গ্রাম), ক্যালসিয়াম ২৪ (মি. গ্রাম), আয়রন ০.২ (মি. গ্রাম), জিংক ০.১৬ (মি. গ্রাম), ভিটা-এ ২৬ (মি. গ্রাম), ভিটা-বি১ ০.০৪ (মি. গ্রাম), ভিটা-বি২ (মি. গ্রাম) ০.০৪ ভিটামিন-সি  ৬৯.৯ (মি. গ্রাম)। (সূত্র বারটান/২০১৬)

সজিনা পাতার গুণাগুণ: বিজ্ঞানীরা মনে করেন সজিনার পাতা পুষ্টিগুণের আঁধার। নিরামিষভোগীরা সজিনার পাতা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারেন। পরিমাণের ভিত্তিতে তুলনা করলে একই ওজনের সজিনা পাতায় কমলা লেবুর ৭ গুণ ভিটামিন-সি, দুধের ৪ গুণ ক্যালসিয়াম এবং দুই গুণ আমিষ, গাজরের ৪ গুণ ভিটামিন-এ, কলার ৩ গুণ পটাশিয়াম বিদ্যমান। বিজ্ঞানীরা আরও বলেন, সজিনা পাতায় ৪২% আমিষ, ১২৫% ক্যালসিয়াম, ৬১% ম্যাগনোসিয়াম, ৪১% পটাশিয়াম, ৭১% লৌহ, ২৭২% ভিটামিন-এ এবং ২২% ভিটামিন-সি সহ দেহের আবশ্যকীয় বহু পুষ্টি উপাদান থাকে।

সজিনার তেল: সজিনার শুকানো বীজ ভাঙিয়ে ৩৮-৪০% ভোজ্য তেল পাওয়া যায় যাতে উচ্চ মাত্রার বিহ্যানিক এসিড থাকে যা বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক। এ তেলের কোনো গন্ধ নাই এবং অন্য যে কোনো ভোজ্য তেলের মতোই মান সম্পন্ন। তেল নিষ্কাশনের পর প্রাপ্ত খইল সার হিসেবে এবং পানি শোধনের কাজেও ব্যবহার হয়।

সজিনার ঔষধি গুণাগুণ: ভারতীয় আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র মতে, সজিনা গাছ ৩০০ রকমের রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। আধুনিক বিজ্ঞানও এ ধারণাকে সমর্থন করে। সজিনার কচি পড সবজি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। সজিনার বাকল, শিকড়, ফুল, ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাতেও ঔষধিগুণ আছে।

০১. শরীর ব্যথা: শরীরের কোনো স্থানে ব্যথা হলে বা ফুলে গেলে সজিনার শিকড়ের প্রলেপ দিলে ব্যথা ও ফোলা সেরে যায়।

০২. কান ব্যথা: সজিনার শিকড়ের রস কানে দিলে কানের ব্যথা সেরে যায়।

০৩. মাথা ব্যথা: সজিনার আঠা দুধের সাথে খেলে মাথা ব্যথা সেরে যায়। আঠা কপালে মালিশ করলে মাথা ব্যথা সেরে যায়।

০৪. ফোঁড়া সারায়: সজিনার আঠার প্রলেপ দিলে ফোঁড়া সেরে যায়।

০৫. মূত্রপাথরি ও হাঁপানি: সজিনা ফুলের রস দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে মূত্রপাথরি দূর হয়। ফুলের রস হাঁপানি রোগের বিশেষ উপকারী।

০৬. গ্যাস থেকে রক্ষা: সজিনা পাতার রসের সাথে লবণ মিশিয়ে খেতে দিলে বাচ্চাদের পেট জমা গ্যাস দূর হয়।

০৭. কুকুরের কামড়ে: সজিনা পাতা পেষণ করে তাতে রসুন, হলুদ, লবণ ও গোলমরিচ মিশিয়ে সেবন করলে কুকুরের বিষ ধ্বংস হয়।

০৮. জ্বর ও সর্দি: পাতার শাক খেলে যন্ত্রণাধায়ক জ্বর ও সর্দি দূর হয়।

০৯. বহুমূত্র রোগ: সজিনা পাতার রসে বহুমূত্র রোগ সারে।

১০. কোষ্ঠকাঠিন্য ও দৃষ্টিশক্তি: সজিনার ফুল কোষ্ঠকাঠিন্য দোষ দূর করে এবং দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে।

১১. সজিনা ফুল দুধের সাথে রান্না করে নিয়মিত খেলে কাম শক্তির বৃদ্ধি ঘটে। এর চাটনি হজমশক্তি বৃদ্ধি করে।

১২. গেঁটে বাত: সজিনার ফল নিয়মিত রান্না করে খেলে গেঁটে বাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

১৩. ক্রিমিনাশক ও টিটেনাস: সজিনার কচি ফল ক্রিমিনাশক, লিভার ও প্লীহাদোষ নিবারক, প্যারালাইসিস ও টিটেনাস রোগে হিতকর।

১৪. অবশতা, সায়াটিকা: সজিনার বীজের তেল মালিশ করলে বিভিন্ন বাত বেদনা, অবসতা, সায়াটিকা, বোধহীনতা ও চর্মরোগ দূর হয়।

১৫. পাতার রস হৃদরোগ চিকিৎসায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যবহার হয়।

১৬.  পোকার কামড়ে এন্টিসেপ্টিক হিসেবে সজিনার রস ব্যবহার করা হয়।

১৭. ক্ষত স্থান সারার জন্য সজিনা পাতার পেস্ট উপকারী।

১৮. সজিনা শরীরের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। শরীর থেকে বিষাক্ত দ্রব্য, ভারি ধাতু অপসারণ এবং শরীরে রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপি নিতে সহায়তা করে।

১৯. ইন্টেস্টাইন ও প্রোস্টেট সংক্রমণ: সজিনা বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে।

২০. শ্বাসকষ্ঠ, মাথা ধরা, মাইগ্রেন, আর্থাইটিস এবং চুলপড়া রোগের চিকিৎসায় ও সজিনা কার্যকর ভূমিকা রাখে।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির করগাঁও বসবাসকারী বিশিষ্ট সাংবাদিক আব্দুর রউফ ভূঁইয়া বলেন, সজনের কাঁচা লম্বা ফল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়, পাতা খাওয়া হয় শাক হিসেবে। খরা সহিষ্ণু ও গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের একটি উদ্ভিদ। ডাল ও বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করলেও আমাদের দেশে সাধারণত ডালের মাধ্যমে বা অঙ্গজ জননের মাধ্যমে বংশবিস্তার করানো হয়। গ্রীষ্মকাল বিশেষত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত ডাল রোপণের উপযুক্ত সময়।

কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার হোসেনপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক আশরাফ আহমেদ (সোহাগ) জানান, সজিনা খাবার  টেবিলে সবজি হিসেবেই বেশি ব্যবহার হয়। মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সজিনা বাজারে প্রচুর পাওয়া যায়। এ সময় খরিপ সবজির মধ্যে সজিনার যথেষ্ট কদর থাকে। আগাম সজিনা বাজারে নিতে পারলে আর্থিকভাবে প্রচুর লাভবান হওয়া যায়। সজিনা দিয়ে ডাল তরকারিটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। সজিনা শুধু ফল হিসেবেই নয় সজিনার কচি পাতা ও ডাঁটা বা ডাল ভাজি বা তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়।

উক্ত উপজেলার সিদলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন (এম এ) বলেন, পালংশাকের বিকল্প হিসেবে সজিনা শাক খাওয়া হয়। মুরগির মাংস রান্নায় কচি সজিনা পাতা সুস্বাদু লাগে। কালিজিরা, কাঁচামরিচ, রসুনের সাথে সজিনা পাতার ভর্তা একটি মজাদার খাবার। ছোট মাছের সাথে সজিনা পাতার চর্চড়ি খুবই উপাদেয়। সজিনা পাতার বড়া, সালাদ, পাতা বাটা ও সজিনা পাতার পাউডার দ্বারা খাদ্য সুস্বাদু ও শক্তি বর্ধক হয়। যে কোনো স্যুপের সাথে শুকনা সজিনা পাতার পাউডার মিশালে খাদ্যমান বেড়ে যায়। 

গ্রীন নিউজ বিডির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দাঁতের মাড়ির ব্যথায় প্রাথমিক সমস্যায় সজনে পাতা জলে দিয়ে ফুটিয়ে গার্গল করলে মাড়ির ইনফেকশন কমায়।

সতর্কতা: এর অনেক উপকার আছে আবার এর কিছু ক্ষতিকর বিষয়ের মধ্যে মারাত্মক হলো গর্ভাবস্থায় সজনে, এর পাতা কোনটাই খাওয়া যাবে না; বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর সজনের শেকড় আরো মারাত্মক। মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং সাবধান।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker