বিনোদন

‘গিটারের জাদুকর’ আইয়ুব বাচ্চুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

‘সে তারা ভরা রাতে, আমি পারিনি বোঝাতে, তোমাকে আমার মনের ব্যথা…’ আজও লক্ষকোটি শ্রোতার বুকে শীতল ঝড় তুলে যায় গানের এই সুরেলা শব্দগুচ্ছ। অথচ এই সুরের স্রষ্টা আর নেই! এমন কালজয়ী বহু গানের স্রষ্টা, বাংলা সংগীতজগতের এক মহান দিকপাল, রুপালি গিটার হাতে সুরের সম্রাট আইয়ুব বাচ্চু নেই আজ পাঁচ বছর। তবু রয়ে গেছে তাঁর অমর সৃষ্টি। আজও জীবন্ত, আজও প্রাণবন্ত!

উপমহাদেশের কিংবদন্তি গিটারিস্ট, সুরের জাদুকর, গীতিকার ও সংগীতশিল্পী, এলআরবির প্রতিষ্ঠাতা আইয়ুব বাচ্চুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন এই কিংবদন্তি। তাঁর বাবার নাম ইশহাক চৌধুরী, মা নুরজাহান বেগম। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন রক ব্যান্ডের গান শুনতেন। সেখান থেকেই ব্যান্ডের প্রতি ও গিটার বাজানোর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর বাবা তাঁকে ১১তম জন্মদিনে একটি গিটার উপহার দেন। সেই থেকেই গিটার বাজানোর প্রতি তাঁর আগ্রহ আরো বেড়ে যায়।

তাঁকে গিটার শেখাতেন জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ গিটার বাদক, যিনি তখন চট্টগ্রামে থাকতেন।

১৯৭৮ সালে তিনি ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে পথচলা শুরু করেন। এরপর ১০ বছর সোলস ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট হিসেবে কাজ করেন। নব্বইয়ের দশকে যাত্রা শুরু হয় ব্যান্ডদল ‘এলআরবি’র। আইয়ুব বাচ্চু মৃত্যুর আগে সুদীর্ঘ ২৫ বছর কাটিয়েছেন নিজ হাতে গড়া এলআরবির সঙ্গে।

১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল সোলস ছেড়ে এলআরবি গড়ে তুলেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। শুরুতে ব্যান্ডটির নাম রাখা হয়েছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড (এলআরবি)। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সালে এই নাম বদল করে রাখা হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’ (এলআরবি)। শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে সংগীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন আইয়ুব বাচ্চু।

পিতা-মাতার আদরের সন্তান হলেও তাঁর সংগীত চর্চায় ছিল অনেক বাধা। সংগীতপ্রেমী বাচ্চু পারিবারিক নিষেধ উপেক্ষা করেই নিজের স্বপ্ন জয় করেছেন। তবে জয়ের নেপথ্যে রয়েছে কঠিন-করুণ গল্প। ১৯৮৩ সালে মাত্র ৬০০ টাকা পকেটে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। কিন্তু অদম্য স্পৃহা, কঠোর পরিশ্রম ও সাধনায় তিনি অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর আইয়ুব বাচ্চু হয়ে ওঠেন। এককথায় দীর্ঘদিন তিনিই ছিলেন দেশীয় ব্যান্ড সংগীতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী তারকা। কণ্ঠ-সুর আর গিটারের মন্ত্রণায় মাতোয়ারা করে রেখেছেন গানপ্রেমীদের। ভূষিত হয়েছিলেন গানের ‘বস’ খেতাবে।

আইয়ুব বাচ্চু মূলত রকস্টার। কিন্তু ব্যান্ড কিংবা রক তারকা হলেও অন্যান্য ঘরানার গানেও তিনি পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে আধুনিক এবং লোকগানে তিনি দক্ষতার প্রমাণ রেখে গেছেন। নিজের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় অন্যান্য শিল্পীর জন্য আধুনিক, লোক এবং ক্লাসিক্যাল ঘরানার গানও তৈরি করেছেন তিনি। জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুর তাঁর গানের আদর্শ ছিলেন বলে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আইয়ুব বাচ্চু জানিয়েছেন। সুখের চেয়ে বেদনার চিত্রই গিটার জাদুকরের গানে বেশি ফুটে উঠেছে। যেন গানের গল্পেই লুকানো তার জীবন। জীবনের এপাশ-ওপাশ। হয়তো এ কারণে তার হতাশার গানগুলো চোখ বুজেই লুফে নিয়েছে শ্রোতারা।

আইয়ুব বাচ্চুর অধিক জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট’, ‘নীল বেদনা’, ‘আসলে কেউ সুখী নয়’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘এই রুপালী গিটার ফেলে’, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ফেরারী মন’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কয়েকটি প্রজন্মকে গানের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সেই ক্যাসেট-ফিতার কাল পেরিয়ে স্মার্টফোন-ল্যাপটপের যুগে এসেও তাঁর গানের আবেদন কমেনি এতটুকুও। অটোগ্রাফের জমানা শেষে ফটোগ্রাফের আমলে, বাঙালির চিঠি লেখার অভ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার পরে, ই-মেইল, ফেসবুকের কালে প্রবেশের পরও তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি একটুও।

দীর্ঘ কয়েক দশকে অসংখ্য কালজয়ী, জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। ‘চলো বদলে যাই’, ‘হাসতে দেখো’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘রুপালি গিটার’, ‘মেয়ে’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘সুখের এ পৃথিবী’, ‘ফেরারী মন’, ‘উড়াল দেবো আকাশে’, ‘বাংলাদেশ’, ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি’, ‘এক আকাশের তারা’, ‘সেই তারা ভরা রাতে’, ‘কবিতা’, ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’, ‘তিন পুরুষ’, ‘যেও না চলে বন্ধু’, ‘বেলা শেষে ফিরে এসে’,  ‘তিন পুরুষ’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। 

এদিকে সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষিত হচ্ছে আইয়ুব বাচ্চুর গান। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি সংগীত তারকা, যার গান সরকারি ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আর এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী। ইতোমধ্যে ২৭২টি গান সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের উদ্যোগে আইয়ুব বাচ্চু স্মরণে খোলা ওয়েবসাইটে। পরবর্তী সময়ে তার নামে কপিরাইট করা গানগুলোই এখানে ছাড়া হবে।

অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীকে কাঁদিয়ে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর না-ফেরার দেশে চলে যান ব্যান্ডসংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র আইয়ুব বাচ্চু। আজ ১৮ অক্টোবর কিংবদন্তি এই ব্যান্ড তারকার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। সংসারজীবনে তিনি স্ত্রী, ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব নামে এক কন্যা ও আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব নামে এক পুত্রসন্তান রেখে গেছেন।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker