লালমনিরহাট

তীব্র শীতেও তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম

পৌষ শেষে মাঘ মাসের শুরুতেই শীত যেন তীব্র থেকে আরও তীব্রভাবে লালমনিরহাট জেলায় জেঁকে বসতে শুরু করেছে। এতে খেটে খাওয়া মানুষগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সূর্যের দেখা নেই। তার ওপর ঘন কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাস বইছে। এমন প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও জীবন বাঁচার তাগিতে যে যার মতো কাজে বাহির হচ্ছেন খেটে খাওয়া মানুষগুলো। লালমনিরহাট জেলা শহরে শীত উপেক্ষা করে খুব সকালে গ্রাম থেকে ছুটে আসেন নানা শ্রেণি পেশার মানুষ ।

লালমনিরহাট জেলার মিশনমোড় এলাকায় শীতের হিমেল হাওয়ার মধ্যেও কাজের সন্ধানে আসেন তিস্তা চরাঞ্চলের আউয়াল হোসেন (৫৩) নামের এক দিনমুজুর। মাথায় মাফলার পেচানো হাতে দা নিয়ে তাকে বসতে থাকতে দেখা যায়। কখন তাকে গৃহস্থ কর্তা তাকে নিয়ে যাবে? কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, মা আর তিন ছেলে মেয়েসহ মোট ছয়জনের সংসারে তিনিই একমাত্র উপার্জনকারী। একদিন কাজ না করলে পরিবারের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়। তাই শীত বলেন আর গরমই বলেন দিনমুজুরীর কাজ তাকে করতেই হয়।

মিশনমোড়ে ভাপা পিঠা বিক্রি করছিলেন আবেদা বেগম নামে পঞ্চাশোর্ধ্ব আরও এক নারী। জীবিকার তাগিদে এই বয়সেও শীতের মধ্যে ঘরে বসে থাকতে পারেননি তিনি। ভাপা পিঠা খেতে খেতে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। দুই মেয়ে ও এক ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। তারা অন্যত্র থাকে। স্বামী অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। সংসারের খাবার এবং স্বামীর ওষুধের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন ভোর বেলা থেকে শুরু করেন ভাপাপিঠা বিক্রি। সকাল ১০টা পর্যন্ত তাঁর পাঁচ-ছয় কেজি চালের ভাপা বিক্রি হয়। প্রতিটি ভাপা পিঠা ১০ টাকা।

আবেদা বেগম আরও বলেন, ‘শীতের শুরু থিকি (থেকে) এই পিঠা বেচার (বিক্রির) কাজ করি আসছি। যখন যেটা সময় আইসে তখন সেইটা করি। একলাই (একা) এই কাজ করি আসতেছি। কাজ কাম না করলে খামো কী বাহে? ছাওয়া তিনটার বিয়া হইছে। দুইটা মেয়ে, আর একটা ছেলে। তামরা (তারা) আলাদা থাকে। কাজ করিয়া স্বামীক দেখা লাগে। স্বামী পঙ্গু না হইলে এত কষ্ট করা লাগিল (লাগতো) না হয়। ‘

সকাল সাড়ে সাতটায় জেলা শহরের বিডিআর রেলগেট এলাকায় শীতে জবুথবু হয়ে ভ্যানে করে শীতের সবজির ভাড়া নিয়ে যাচ্ছিলেন ভ্যান চালক রহিম মিয়া (৪৭)। তার বাড়ি মোগলহাট ইউনিয়নের ভাটিবাড়ি এলাকায়। প্রায় ১৪ বছর থেকে তিনি ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে বলে তিনি জানান। তার এই ১৪ বছরে এমন তীব্র শীত তিনি দেখেন নাই। তীব্র শীত আর ঘনকুয়াশায় ভ্যান চালাতে তাকে অনেকবার বিপদে পড়তে হয়েছে। তারপরেও জীবন যুদ্ধে তাকে ভ্যান নিয়ে বাহির হতে হয়।

জেলার প্রানকেন্দ্র মিশনমোড় এলাকার চা বিস্কুট বিক্রয়কারী আনিছার রহমান বলেন, ‘শীতের সকালে বাড়ি থেকে বের হতে কষ্ট হয়। কিন্তু উপায় নেই। কাজ করে খেতে হবে। বসে বসে থাকলে সংসার চলবে কেমন করে। ছয়টা থেকে জেলার মিশনমোড়ের এই জায়গাটায় ভাপা পিঠা বিক্রি শুরু হয় তাই প্রতিদিন শীতের সকালেও জীবিকার তাগিতে ছুটে আসতে হয়।’ তিনি জানান, সকালে যাঁরা হাঁটতে বের হন, এমন কিছু নিয়মিত ক্রেতা তাঁর আছে যারা তার দোকানে লাল চা খেয়ে যান।

দুপুর আড়াইটা বাজে তখনো সূর্যের দেখা নেই। শীতের কনকনে হিমেল হাওয়ার মধ্যেও আয় রোজগারের জন্য পথে নেমেছেন ওবায়দুল ইসলাম নামের এক যুবক। তাঁর বাড়ি গোকুন্ডা ইউনিয়নের জোলাপাড়া গ্রামে। তিনি একজন ভ্রাম্যমান মাথর টুপি, মুজা, মাফলারসহ শীতের সরঞ্জাম বিক্রেতা। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে তাঁর আয় হয় ৩০০-৪০০ টাকার মতো। সে একজন ছাত্র হয়েও সাতসকালে এই কাজ করে আসছেন।

ওবায়দুল ইসলাম বলেন, তার বাবা নেই। ‘মা আর এক ছোট বোন নিয়ে সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। পাশাপাশি নিজের পড়ালেখার খরচও তাকেই আয় করতে হয়। শীত এলেই তাই বাড়তি আয়ের জন্য প্রতিদিন তার এই ঠান্ডার উপসমের এই জিনিসপত্র নিয়ে বাহির হন। এতে কিছু আয় হয়। তবে গত কয়েক দিন থেকে ঘন কুয়াশায় খুব কষ্ট হচ্ছে। এরপরও ছুটে আসছি।

মাঘের শুরুতেই শীতে মানুষজন কাহিল হয়ে পড়েছেন। তার ওপর উত্তরের হিমেল হাওয়া বইছে। তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের দিনমজুরেরা কাকডাকা ভোরে ছুটে আসেন শহরের মিশনমোড় গোল চত্বর এলাকায়। সেখানে শ্রম বিক্রির জন্য দল বেঁধে বসে থাকেন তাঁরা। কখনো কাজ জোটে, আবার কখনো জোটে না। তাঁরা বিভিন্ন বাসাবাড়ির নির্মাণসামগ্রী, বালু ও ইট এক স্থান অন্য স্থানে নেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করেন।

সকাল আটটার দিকে মিশনমোড় গোল চত্বর এলাকায় কাজের সন্ধানে আসা ২০ থেকে ২৫ জন দিনমজুরের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের সবার সঙ্গে একটি করে বাইসাইকেল। আজিজুল ইসলাম (৪৫) নামের একজন দিনমজুর বলেন, ভোরবেলা বাড়ি থেকে গরম ভাত খেয়ে ১৬ কিলোমিটার দূরের পথ থেকে এখানে ছুটে এসেছেন কাজের সন্ধানে। এটি তাদের প্রতিদিনের চিত্র। শীতের সকালে বাড়ি থেকে বের হতে খুব কষ্ট হলেও আসতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর মতো আরও অনেকেই এমন বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও শহরে ছুটে এসেছেন শুধু জীবিকার তাড়নায় ।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker