কিশোরগঞ্জ

ভালো নেই গ্রাম গঞ্জে পিড়িতে বসিয়ে চুল-দাড়ি কাটা নরসুন্দরেরা

ভালো নেই নরসুন্দরেরা, মানবেতর জীবনের দখলে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের হাট বা গঞ্জে বসে চুল কাটা সেভ করা নরসুন্দরেরা। একটা সময় ছিল, যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে চুল-দাড়ি কাটতেন অসংখ্য নর সুন্দর। এখন তেমন একটা দেখা মিলেনা সেই নরসুন্দরদের। প্রতিটি বাজারে উন্নত মানের সেলুন ব্যবসা শুরু হবার কারনে, মানুষের মনে আধুনিকতার ছুয়া লাগার ফলশ্রুতিতে সেলুন গুলিতে উন্নত মানের প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহারের কারনে বহুকালের ঐতিহ্যগত চুলকাটার কারিগরদের খুব কমই দেখা যায় মফস্বলে।

সব শ্রেণী-পেশার মানুষ অন্যের কাছে নিজেকে সুন্দর রুপে উপস্থাপন করতে ব্যস্ত। মানুষকে চুল-দাড়ি কেটে দেখতে সুন্দর করা যাদের কাজ তারাই নরসুন্দর। আঞ্চলিক ভাষায় তাদের বলা হয় নাপিত।

কেউ কেউ আবার পিড়িতে বসে চুল কাটতে লজ্জাবোধ করেন অথচ সেই ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে কে না গিয়েছে নিকটতম হাটের পিড়িতে বসে চুলকাটা নরসুন্দরের কাছে? পঞ্চাশোর্ধ কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠের সাথে কথা বলছিলাম জানতে পারি তারা এক টাকায় কাটাতেন চুল,পচিঁশ পয়সায় দাড়ি।

মতি মিয়া নামে একজন নরসুন্দরের সাথে কথা বলছিলাম তার বাড়ী ধুলিহর গ্রামে সিদলা ইউনিয়নের অন্তর্গত তিনি ৪০ বছর ধরে বিভিন্ন হাট বাজারে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে নরসুন্দরের কাজ করে থাকেন। শুরুতে এক টাকার বিনিময় চুল আর পঁচিশ পয়সায় দাড়ি গোঁফ সাইজ করতেন, তখন ভালো আয় রোজগার হতো আর এখন বাজার মূল্য বাড়লেও সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত মনে বাড়ী ফিরেন সন্তোষজনক রোজগার হয়না।

তিনি জানান-সিদলা ইউনিয়নের পাগলা বাজারে তার ছেলেদের একটি উন্নতমানের সেলুন রয়েছে কিন্তু তিনি বহু বছরের ঐতিহ্য টা ছাড়তে পারছেন না। তার মতে গ্রামে গঞ্জে কাজ করলে সকল বয়সের প্রিয় মানুষদের দেখা মিলে যা এই বৃদ্ধ বয়সে মনের প্রশান্তি আনে। উল্লেখ্য সুপারি গাছের খোলস দ্বারা তৈরি চমকপ্রদ সুন্দরের বহিঃপ্রকাশ তাদের যন্ত্রাংশ রাখার পাত্রটি একটি বাজারের ব্যাগে করে ঘুরে বেড়ান গ্রামে গ্রামে। বসেন উপজেলার সদর, পিতলগঞ্জ, ভোটের বাজার, গড়বিশুদিয়া, হারেঞ্জাসহ বেশ কয়টা বাজারে।

উপজেলার সদরে সরেজমিনে দেখা যায় চুল-দাড়ি কাটছেন, সুনিল(৯০), তার চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই এ পেশার সাথে জড়িত। উপজেলা সদরের হনুমান তলায় ছোট ভাই রাখালের সেলুন থাকলেও তারা বড় দুই ভাই সুনিল আর বুদ্ধু পিড়িতে বসে চুল দাড়ি কাটেন বাজারে। এ পেশায় এখন সংসারের খরচ জোগান দেওয়া বড়ই কঠিন। বর্তমান সেভ ১৫ টাকা ও চুল কাটা ৩০ টাকা।তাও আবার সারাদিন বসে থেকে ৪/৫ টা কাস্টমার জুটে। আধুনিক ছোঁয়া না লাগলেও বাপ-দাদা আমলের সেই স্মৃতি ধরে রেখেছেন উপজেলার হাতেগোনা কয়েক জন নরসুন্দর।

সাংবাদিক সঞ্জিত চন্দ্র শীল জানান, এক সময় হাট-বাজারে পিড়িতে বসে চুল-দাড়ি কাঁটত মানুষ। কিন্তু কালের বিবর্তনের আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের চুল-দাড়ি কাটার আদি-পরিচিত দৃশ্য এখন অনেকটা কমে গেলেও হোসেনপুর উপজেলায় বিভিন্ন হাট-বাজারে চোখে পড়ে সেই দৃশ্য।

সুশীল সমাজের সচেতন নাগরিক হোসেনপুর আদর্শ ডিগ্রি মহিলা কলেজের অধ্যাপক আশরাফ আহমেদ (সোহাগ) বলেন, আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে হাটে-বাজারে পিড়িতে বসা এই সেলুনগুলো। বর্তমান সময়ে বড় বড় মার্কেটে ঘর সাজিয়ে এমন কি শিতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে নর সুন্দরেরা মানুষের চুল কাটার কাজ করছেন। মানুষের সুন্দর্যের অন্যতম উপকরণ চুল এই চুল নিয়ে যুগে যুগে মানুষের ভাবনার অন্ত নেই। সেই কারণে নাপিতদের কদর ও প্রয়োজনীয়তা আজও ফুরিয়ে যায়নি।তবে বর্তমান দ্রব্যমূল্যের চড়া বাজারে অসহায় দিনাতিপাত করেন পিড়িতে বসিয়ে চুল দাড়ি কাটা নরসুন্দরেরা।

উপজেলার সিদলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন বলেন, আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ফলে আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গতি ধারায় এসেছে পরিবর্তন। লেগেছে নতুনত্বের ছোঁয়া। হারিয়ে যেতে বসেছে হাটে-বাজারে বসা ভ্রাম্যমান সেলুন।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker