বাণিজ্য

চীনে তৈরি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য বাংলাদেশে এনে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি

চীনে তৈরি হচ্ছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেবেলযুক্ত পণ্য। এসব পণ্য মিথ্যা ঘোষণায় বাংলাদেশে এনে তা আবার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করছে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) একটি চীনা প্রতিষ্ঠান।

এক দেশে থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্য ভিন্ন দেশ থেকে উৎপাদন ও লেবেলযুক্ত করা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ আইন লঙ্ঘন। এ আইন লঙ্ঘন শস্তিযোগ্য অপরাধ।

সিইপিজেডের চীনা প্রতিষ্ঠান কনডা আর্ট ম্যাটেরিয়াল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমন অভিনব জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট।

বন্ড কমিশনার এ কে এম মাহবুবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কনডা আর্টের আগের সব রপ্তানি ও আমদানির তথ্য এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বিস্তারিত তদন্তের পর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই ধরনের অনিয়ম আরও একাধিক চীনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পাওয়া যাচ্ছে। পুরো বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।’

রপ্তানি নথির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের ডলার ট্রি নামের প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব পণ্য রপ্তানি করে থাকে। গত জুন মাসে প্রতিষ্ঠানটি অন্তত ১৪টি চালান ডলার ট্রি প্রতিষ্ঠানের কাছে রপ্তানি করে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সার্ভারে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে তৈরি পণ্যের সুনাম ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে এমন অনিয়ম করছে প্রতিষ্ঠানটি।

এতে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি খাতে বড় ধরণের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের মে মাসের শুরুর দিকে চীনা প্রতিষ্ঠানটির কারখানার ভেতরে ও রপ্তানির উদ্দেশে রাখা ১০টি ট্রাকের পণ্য জব্দ করা হয়। সে সময় প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের ৭ লাখ ৬০ হাজার পিস ফেব্রিক, মেটালিক ও পলেস্টারের তৈরি ব্যাগ, ইয়ারফোন বক্স, লাঞ্চ বক্স জব্দ করেন বন্ড কর্মকর্তারা।

এরপর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা করেন বন্ড কর্মকর্তারা।

বন্ড কর্মকর্তাদের মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, এসব পণ্য মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে শুল্ককর পরিশোধ না করে এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের ফাঁকি বাংলাদেশে আসে। পরে সেগুলো ডলার ট্রি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে রপ্তানি করা হয়।

সিইপিজেডে কারখানার ভেতরে অভিযান চালানোর সময় দেখা যায়, যেসব পণ্য রপ্তানি করার জন্য রাখা ছিল, সেগুলো উৎপাদনের মতো যন্ত্রপাতি সেখানে ছিল না। প্রতিষ্ঠানটি আর্ট ফ্রেম তৈরির কাঁচামাল আমদানির নামে তা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করেছিল।

কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেন, শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি এসব কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। কিন্তু যেসব পণ্য আমদানি করে আবার রপ্তানি করেছে তা ৭৩ শতাংশ শুল্কযুক্ত পণ্য।

মিথ্যা ঘোষণায় এসব পণ্য আমদানির প্রমাণ পাওয়ায় এবং লিখিত বক্তব্যে দায় স্বীকার করায় ফাঁকি দেওয়া ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার রাজস্বসহ মোট ৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয় চীনা প্রতিষ্ঠানটিকে।

কনডা আর্ট ম্যাটেরিয়ালস হলো নিংবো কনডা আর্ট সাপ্লাইস গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের ৯০টির বেশি দেশে শিল্প ও কারুশিল্প সামগ্রী সরবরাহ করে থাকে।

প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে শুরু করে।

এ বিষয়ে জানতে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য হোসেন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গত ২৩ জুন তিনি বলেন, ‘দেশে এ ধরনের জালিয়াতি প্রথমবারের মতো শনাক্ত করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘কাঁচামাল আমদানির ঘোষণায় প্রস্তুত পণ্য আমদানি করলে শুল্ককর দেওয়ার পাশাপাশি জরিমানা গুণতে হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। পরবর্তীতে একই অপরাধ করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

যোগাযোগ করা হলে কনডা আর্টের জেনারেল ম্যানেজার এরিক ফু গত ২০ জুলাই একজন অনুবাদকের মাধ্যমে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কাস্টমস বন্ডের সঙ্গে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী জরিমানাসহ ফাঁকি দেওয়া শুল্ক দেওয়া হয়েছে। নতুন করে মন্তব্য করার কিছু নেই।’

কনডা আর্টের বাণিজ্যিক বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পণ্যগুলো ভুলবশত আনা হয়েছিল।’

পণ্যের লেবেলে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখার বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করেননি।

তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে আইন অনুযায়ী বকেয়া ও জরিমানা পরিশোধের পর পণ্য রপ্তানি করতে কোনো বাধা নেই। এছাড়া আমরা ইতোমধ্যে আমাদের কারখানায় ওই পণ্য তৈরির অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছি।’

এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কর্তৃপক্ষ আরও সতর্ক থাকবে বলে জানিয়েছেন সিইপিজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউদ্দিন বিন মেসবাহ।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ইপিজেড কোনো গুদাম নয় যেখানে বিদেশ থেকে পণ্য এনে মজুদ করবে এবং তা অন্য কোনো দেশে আবার রপ্তানি করবে। এখানে নামমাত্র মূল্যে জমি ও অবকাঠামো সুবিধা দেওয়া হয়েছে যেন দেশে মূল্য সংযোজন হয় এবং কর্মসংস্থান হয়। কোনো পণ্যে মূল্য সংযোজন না হলে তা রপ্তানি করার আইনত সুযোগ নেই।’

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker