টাঙ্গাইল

রাসায়নিক শিল্পবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে নদী-খাল

টাঙ্গাইলের সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের রাসায়নিক শিল্পবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে লৌহজং নদী ও পাকুল্যা খালের পানি। কারখানা নিঃসৃত কেমিকেলের দুর্গন্ধে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পরিবেশ-প্রতিবেশ। নদী ও খালের পানি দূষিত হয়ে কালো কুচকুচে বর্ণ ধারণ করেছে। নদী ও খালের মাছ মরে যাচ্ছে। মানুষ ও গৃহপালিত প্রাণির শরীরে দেখা দিচ্ছে দগ্দগে ঘা। লিখিত অভিযোগ পেয়েও পরিবেশ অধিদপ্তর নমুনা সংগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে কার্যক্রম।

জানা যায়, মির্জাপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে লৌহজং নদী ও পাকুল্যা খাল। পাকুল্যা খালের পানি প্রবাহিত হয়ে লৌহজং নদীতে গিয়ে পড়ে। ওই খাল ও নদী মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী, ভাতগ্রাম ও বানাইল ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মানুষের গুরুত্বপূর্ণ খোলা পানির উৎস। ওই খাল ও নদীতে স্থানীয় বাসিন্দারা মাছ ধরা, গোসল, গৃহস্থালির কাজ, অজু, আবাদি জমি এবং গরু-মহিষ-ছাগল সহ গৃহপালিত অন্য প্রাণিকে গোসল করানোর জন্য ব্যবহার করে থাকেন। সাদিয়া টেক্সটাইল মিলসের রাসায়নিক বর্জ্যে খাল ও নদীর পানি কালো কুচকুচে বর্ণ ধারণ করে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানিতে হচ্ছে পোকার উৎপত্তি। এ কারণে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে খাল ও নদীর পানি।

সরেজমিনে জানা যায়, যমুনা সেতু-ঢাকা মহাসড়ক সংলগ্ন মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী ইউনিয়নের বানিয়ারা মৌজায় কয়েক বছর আগে সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। কারখানার দূষিত বর্জ্য খালে ফেলতে গত দুই বছর আগে যমুনা সেতু-ঢাকা মহাসড়কের পাশ দিয়ে মহাসড়কের জমিতে কংক্রিটের পাইপ স্থাপন করা হয়। ওই পাইপের ড্রেন কয়েকটি বাড়ির ভেতর দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে পাকুল্যা খালে নিয়ে সংযুক্ত করা হয়। ওই পাইপের ড্রেন দিয়ে নিয়মিত কারখানার দূষিত বর্জ্য খালে ফেলা হচ্ছে। ওই খালের পানি প্রবাহিত হয়ে লৌহজং নদীতে পড়ছে।

ফলে ক্রমাগত দূষণে পাকুল্যা খাল ও লৌহজং নদীর পানি অসহনীয় দুর্গন্ধ ও কালো কুচকুচে এবং ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে খাল ও নদীর মাছ মরে যাচ্ছে। নদী ও খালের পানি ব্যবহারকারীরা বিপাকে পড়েছেন। তারা নদী ও খাল থেকে মাছ ধরলেও সেই মাছ রান্নার পর দুর্গন্ধে খাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যেই নদীর মাছ মরে ভেসে ওঠছে। কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ চর্মরোগ, পানিবাহিত রোগ এবং উল্লেখযোগ্য পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবজীবন এবং জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে।

পাকুল্যা খালের পাশে বাঁশের চাটাই তৈরির কাজে নিয়েজিত ওই গ্রামের রফিক মিয়া জানান, তিনি ১৫ বছর ধরে চাটাই তৈরির কাজ করছেন। চাটাই তৈরির জন্য আনা বাঁশ পাকুল্যা খালের পানিতে ভিজিয়ে রেখে তারা কাজ করেন। গত দুই বছর ধরে সাদিয়া কারখানার বর্জ্য খালে ফেলায় পানি দূষিত, দুর্গন্ধ ও কালো কুচকুচে হয়ে পড়েছে। পানিতে নামলে শরীরে চর্মরোগ দেখা দেয় এবং চুলকানীতে দগদগে ঘা হয়।

স্থানীয় শ্রমিক আরশাদ মিয়া, ফরমান আলী, রশিদ সহ অনেকেই জানান, বিষাক্ত কেমিকেলের কারণে খালের পানি কালো হয়ে গেছে। নদীর বড় বড় মাছ মাঝে মধ্যেই মরে ভেসে ওঠে। খাল ও নদীর পাশে দুর্গন্ধে বেশি সময় থাকা যায় না। ওই খালের পানি লৌহজং নদীতে পড়ছে। লৌহজং নদীর মাছও মরে ভেসে ওঠছে। রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত পানি নদীতে মিশে যাওয়ায় এখন কেউ নদীতে গোসল করতে পারেন না- নদীর পানি দিয়ে জমিতে সেচ দিতেও পারেন না।

ওই গ্রামের বাসিন্দা রমজান আলী জানান, তাদেরকে দেখার মতো কেউ নাই। কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য খালের পানির রঙ কালেঅ কুচকুচে করে ফেলেছে। তারা আগে নদীর পানি পান করতেন- মাছ ধরতেন। এখন পানি পান করা মাছ ধরা তো দূরের কথা- দুর্গন্ধে আশপাশের বাড়িতেও বসবাস করা দায় হয়ে ওঠেছে। সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত পানি বেশি ছেড়ে থাকে।

কলেজছাত্র কহিনুর ইসলাম, শাকিল ইসলাম, ইমরান খান রাজা সহ অনেকেই জানান, সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের রাসায়নিক বর্জ্য খালের পানিতে ফেলায় জনজীবন, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। মঙ্গলবার পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন এসে পানির নমুনা সংগ্রহের মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রেখেছে। অথচ খালিচোখেই পানি ও কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য দেখা যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এহেন গাছাড়া উদ্যোগের নিন্দা জানান তারা। তারা বর্তমান সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টার কাছে কারখানার দূষিত বর্জ্য খালে ফেলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণের জোর দাবি জানান।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন ফাউন্ডেশনের (বিএমবিএফ) পর্যবেক্ষণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আকিব আকবর খান চৌধুরী জানান, সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের শিল্পবর্জ্যরে দূষণ চরম আকার ধারণ করেছে। যা স্থানীয় পর্যায়ে ফসলের ক্ষতি-নিরাপদ পানির অভাবসহ চরম পরিবেশ-প্রতিবেশ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো চলমান বেপরোয়া ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের কথা অনেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে পরিকল্পিত ও উৎসে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কেউই এ বিষয়ে কর্ণপাত করছেন না।’ তিনি সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের বর্জ্য ফেলা বন্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন বলে জানান।

জামুর্কী ইউপি চেয়ারম্যান ডিএ মতিন জানান, এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পাকুল্যা খালের সাটিয়াচড়া এলাকা পরিদর্শন করে তিনি বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানি দেখতে পান। পরে কয়েকটি গ্রামের ২০-২৫ জন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সাদিয়া কারখানায় গিয়ে মালিকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। টেক্সটাইলের মালিক কারখানার ইটিপিতে সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে দ্রæত সময়ের মধ্যে প্রকৌশলী এনে সমাধান করার ব্যবস্থা করা হবে।

কিন্তু এখনও পর্যন্ত সমাধান করা হয়নি। এলাকার লোকজন ইউপি চেয়ারম্যানকে জানিয়েছেন- খাল ও নদীতে বড় বড় বোয়াল মাছ মরে ভেসে ওঠছে। দুর্গন্ধযুক্ত কালো কুচকুচে পানিতে এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধান করা না হলে স্থানীয় পর্যায়ে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক আব্দুর রহমান মোবাইল ফোনে জানান, কারখানার পানি ইটিপি করে রেঞ্জের মধ্যে রেখে পাইপের পর ড্রেনের মাধ্যমে খালে ফেলা হচ্ছে। এই পানিতে দুর্গন্ধ ও পোকার উৎপত্তি হওয়ার কথা নয়।

টাঙ্গাইল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (স্বাস্থ্য) দীপঙ্কর দাস জানান, প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরের। কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের বিষয়গুলো তাদের দেখার বিধান রয়েছে। তারা এ পর্যন্ত লিখিত অভিযোগের কোন কপি পান নি। লিখিত অভিযোগের কপি হাতে পেলে আইনগত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক জানান, মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছ থেকে অভিযোগের কপি পেয়ে মঙ্গলবার(২৫ ফেব্রুয়ারি ) সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে।

নদী ও খালের পানির স্যাম্পল(নমুনা) সংগ্রহ করে ঢাকায় ল্যাবে পাঠানো হবে। ল্যাব থেকে রিপোর্ট পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের(বিপিউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমান জানান, বিষয়টি আগে জানা ছিল না। তিনি খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

Author

আব্দুস সাত্তার, বিশেষ প্রতিনিধি

নাম আব্দুস সাত্তার। তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি মিশন নাইনটি নিউজের একজন বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker