সারাদেশ

‘ঘুমের ঘরেও ওরা পুলিশ পুলিশ কইয়ে কান্দে উঠে’

চার বছরের নাঈমা আর পাঁচ বছরের আহমুদুল্লাহ সারাক্ষণ বড় বোন আইরিনকে (১০) ঝাপ্টে ধরে বসে থাকে। তাদের চেয়ে আইরিন একটু বড় হলেও সেও শিশু। গত দুই বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর মায়ের আশ্রয়ে লালিত পালিত হলেও মা এখন জেলে।

তাই অবুঝ শিশু জান্নাতুল নাঈমা আর আহমাদুল্লাহর একমাত্র ভরসা দশ বছর বয়সী বড় বোন আইরিন। সেই তাদের বাবা-মা‘র দায়িত্ব পালন করছেন।

আজ সোমবার (২৭ জানুয়ারি) সকালে বিবাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাড. মেহেদী হাসান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে, রবিবার বিকেলে ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌর বাজারের খান প্লাজায় সংবাদ সম্মেলন এমনি আবেগ প্রবণ হয়ে কথা গুলো বলতে শোনা যায় মৃত ব্যবসায়ীর বড় মেয়ে আইরিনকে।

জানা যায়, ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌরসদরের পোল্ট্রি মুরগী ব্যবসায়ী মৃত আমিন শেখ-পপি খাতুন দম্পতির নাবলক তিন শিশু আইরিন (১০), আহমাদুল্লাহ (৫) আর জান্নাতুল নাঈমা (৪) ।

তাদের বাবা ঋণের দায়ে ব্যাংকের দায়ের করা অর্থ ঋণের মামলার আসামি। তাদের বাবার মৃত্যুর শোক মা পপি খাতুন শিশুদের বুঝতে না দিলেও স্বামীর নেওয়া ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করতে পারায় মৃত্যুর দুই বছরের মাথায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

এ মামলায় তাদের মা পপি খাতুন দুইমাস যাবত জেলহাজতে থাকায় শিশুদের জীবন এখন বিষাদে ভরা ও যন্ত্রণায় কাতর। তাদের মা জেলে যাওয়ার পর থেকেই বৃদ্ধ দিনমজুর নানার কাছে আশ্রয় পেয়েছে শিশু তিনটি। দিশেহারা নানা এতিম শিশুদের নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।

মামলা সূত্রে জানা যায়, বোয়ালমারী পৌর সদর বাজারের পোল্ট্রি মুরগী ব্যবসায়ী আমিন শেখ ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিনি ব্যাংক থেকে ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর ৩০ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। তিনি (আমিন শেখ) জীবিত থাকা অবস্থায়  কিস্তিতে সুদে আসলে ৬ লাখ ২১ হাজার ৩৭৮ টাকা ঋণ পরিশোধ করেন।

তার মৃত্যুর পর ২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর ফরিদপুর জেলা জর্জ ১ম অর্থঋণ আদালতে মৃত আমিন শেখের স্ত্রী পপি খাতুন, তিন নাবালক শিশু সন্তানসহ, আমিন শেখের মা সালেহা বেগম ও প্রতিবেশী মো. চুন্নু মিয়ার নাম উল্লেখ পূর্বক ৬ জনের নামে মামলা দায়ের করে ব্যাংক।

মামলায় ২৫ লাখ ৯৩ হাজার ২৮৩ আসল, ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩২৯ টাকা সুদ ও ৬০ হাজার ৫৭০ টাকা আইনী খরচ বাবদ মোট ২৯ লাখ ৯৩ হাজার ১৩৮ টাকা পরিশোধের ডিক্রি জারি করে আদালত। অথচ মামলার বিষয়ে কিছুই জানতো না আসামিরা।

মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়, ফরিদপুর জজ আদালতের বাদির পক্ষের আইনজীবী তার স্বাক্ষরিত আর্জিতে বিবাদীগণের নামে ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর সালে লিগ্যাল নোটিশ জারি করেছেন। অথচ ঋণ গৃহীতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেন তারও ১ বছর পর ২০২২ সালে। গত বছরের ২ ডিসেম্বর মোসা. পপি খাতুন গ্রেপ্তার হলে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন মৃত আমিন শেখের ঋণের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

অনুসন্ধ্যানে দেখা যায়, ব্রাক ব্যাংক পিএলসি বোয়ালমারী শাখা আমিন শেখের দুই এতিম নাবালক মেয়ে ও নাবালক ছেলের বয়স গোপন করে তাদেরও মামলার আসামি করেছে। মায়ের গ্রেপ্তারের পর থেকেই একই মামলার আসামি তিনটি এতিম নাবালক শিশু সারাক্ষণ শঙ্কা ও আতংকের মধ্যে থাকে কখন জানি তাদেরও পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত তিন শিশুর নানা বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের বান্দুগ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ সিরাজ শেখ বলেন, ওদের মায়ের জামিন করাতে আদালতে ঋণের ৭ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। অভাগা নাতি-নাতনীরা এখনো ঠিকমতো টাকা, ঋণ ও লেনদেনের অর্থই বোঝে না। মামলায় তাদের বয়স লুকিয়ে তাদের আসামী করা হয়েছে। নাই জমি জমা, নেই ভিটে মাটি। সহায় সম্বল হারিয়ে তিন তিনটি এতিম শিশু নিয়ে এমনিতেই দিশেহারা অবস্থা আমার। আমার মেয়ে পপি খাতুন জেলে যাবার পর আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে তিনটি অবুঝ শিশু। আমি দিনমজুর। নিজেরই সংসার চলে না তার উপর যুক্ত হয়েছে কন্যার এতিম তিন নাবালক সন্তান। 

এ সময় কান্না জড়িত কন্ঠে শিশু আইরিন বলেন, “ভাই বোন দুটো পুলিশের ভয়ে কান্দে! কখন যেন আমাগেরও পুলিশ ধরবার আসে, ঘুমের ঘরেও ওরা পুলিশ পুলিশ কইয়ে কান্দে উঠে।” ‘আমার আব্বার লোন মাফ করে আমার মারে ছাড়ায় আইনে দেন।‘

এ বিষয়ে ব্রাক ব্যাংক বোয়ালমারী শাখার ব্যবস্থাপক রাসেল আহমেদ বলেন, ঋণ গ্রহীতা মৃত আমিন শেখ আমাদের শাখা থেকে ৩০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। আমাদের ব্যাংকের শর্ত ও নিয়মের মধ্যে থেকেই চলমান ব্যবসার অনুকূলে ঋণ দেওয়া হয়েছে। শর্তাবলী মেনেই ঋণের টাকা অনাদায়ে জামিনদার ও ওয়ারিশগণের নামে মামলা হয়েছে। এতিম নাবালক শিশু সন্তান মামলার বিষয়ে আমাদের আইনজীবী ভালো বলতে পারবেন।

আজ সোমবার সকালে বিবাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাড. মেহেদী হাসান বলেন, মৃত আমিন শেখের অপ্রাপ্ত বয়সী তিনটি অবুঝ শিশুকে এ মামলায় ওয়ারিশ সূত্রে আসামি করা হয়েছে। তারা ওয়ারিশ হলেও বয়ঃপ্রাপ্তির আগে বাবার সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের আসামি করা তামামি আইন সমর্থন করে না। এটা স্পষ্ট আইনের ধারায় উল্লেখ রয়েছে। শিশুদের বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছে নিঃসন্দেহে তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আদালতকে ভুল তথ্য দিয়েছে। 

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker