ইতিহাস ও ঐতিহ্য

জিঞ্জিরা থেকে নবাবগঞ্জ মডেল ১৯৪৫ বাসে

মডেল ১৯৪৫ বাস। যা ‘মুড়িরটিন’ বাস নামে পরিচিত। অনেকটা জমির সমতল মেঠো পথ ধারে জিঞ্জিরা থেকে সৈয়দপুর হয়ে নবাবগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করতো । সেটা ১৯৬৭-৬৮ সালের কথা। বাসগুলো ছিল মোমিন কোম্পানির।

কোম্পানি নিজস্ব খরচায় রাস্তা বানিয়ে বাস চলাচলের উপযোগী করে তোলেন। শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ৪/৫ মাস মাটি পথে ধুলা উড়িয়ে বাসগুলো চলাচল শুরু করতে থাকে। এতে বান্দুরা নবাবগঞ্জ লাইনের লঞ্চযাত্রীরা একটু ভিন্ন স্বাদের দ্রুতগতির গাড়ির আমেজ পেতে মরিয়া হয়ে উঠে।

এ রুটে যাত্রী সংখ্যা বাড়তে লাগল, বর্ষার কয়েক মাস বাসগুলো বসে থাকলেও এদের পুষিয়ে যেত। চলন্ত লঞ্চ থেকে কুণ্ডলিকারে ধুলা দেখে বোঝা যেত, বাস চলছে।

যাদের খুব তাড়া থাকত না কিংবা মালামাল বেশি থাকত তারা দেরি হলেও লঞ্চেই সদরঘাট বা ফতুল্লা যেত। লঞ্চে ফতুল্লা থেকেই চাক্কার গাড়ি দেখলেই মন প্রফুল্ল হয়ে উঠত। তখন এত স্বল্প সংখ্যক বাস বা প্রাইভেট কার চলত তা সহজেই গোনা যেত।

মোমিন কোম্পানি কয়েক বছর ব্যবধানে বছরব্যাপী চলার জন্য নিজেরাই চাক্কার সমান করে দুই লাইনের ইট বিছিয়ে নিলেন। শুষ্ক মৌসুমে ভাল চললেও বৃষ্টির সময় নিচের মাটি নরম হয়ে ইটের লাইন দেবে যেত, অবস্থা এমন হত যে উঁচু নীচু পাহাড়ি পথের মত দোল খেতে খেতে এগোতে হত।

মাঝে মাঝে ওরা বালু ফেলে সমান করার চেষ্টা করত। দুই লাইনের ইট বিছানো পথে খানিক দূরত্বে বাস ক্রসিং এর জন্য বৃত্তাকার পয়েন্ট ছিল। দূর থেকে বিপরীত মুখি বাস আসতে দেখলেই একটি বাস নিকটবর্তী বৃত্তাকার পয়েন্টে দাঁড়িয়ে যেত বাসগুলো লাভ বেশী করার জন্য ভিতরে বসার জন্য চারদিকে কাঠের বেঞ্চি থাকত।

ড্রাইভার বাসের সামনে একটি ঘেরাও করা চেম্বারে চালকের আসনে বসে বাস চালাইতেন। ড্রাইভারের কেবিনের পেছনে মহিলাদের আলাদা কেবিনে বসার ব্যবস্থা ছিল। যদি কেও ড্রাইভারের সাথে সামনে সিটে বসতে চাইলে গুনতে হতো তুলনা মুলক বেশি ভাড়া, মহিলাদের বক্স সিটের ক্ষেত্রেও তাই, এসব বাসে মাঝখানে মুরগি খাঁচির মত লোকজন দাঁড় করিয়ে উঠাত,

বাসের ছাঁদসহ ভরে যাওয়ার পরও সহসা ছাড়ত না, যাত্রীরা গরমে অনেকে হাঁপিয়ে উঠত, হেলপার কর্তৃক স্টার্ট দেয়ার লোহার হাতল বের করার শব্দ পেলে স্বস্তি বোধ হত। একইসাথে ড্রাইভার হাতে পাম্প করে হর্ন বাজাত। হাতল ঘুরিয়ে স্টার্ট হলে সুবাসিত পেট্রোলের ঘ্রাণ পাওয়া যেত।

তখন বাস স্টার্ট করার এখনকার মত কোন সেল্ফ স্টার্টার ব্যবস্থা ছিল না। লোহার দণ্ড দিয়ে নির্মিত হ্যান্ডেল যা (দ) আকারে ছিল৷ এই হ্যান্ডেল গাড়ির সামনের অংশের একটি ছিদ্রের ভিতর ঢুকিয়ে ইঞ্জিনের অংশে লাগিয়ে জোরে জোরে ঘুরিয়ে বাস স্টার্ট করা হইতো। সে অতীতে এখনকার মত হাইড্রলিক হর্ন ছিল না।

রবার দিয়ে বানানো বেলুন আকৃতির হর্ন বা ভেপু হাত দিয়ে টিপে বাজানো হতো। গাড়ির ভিতরে পেছন থেকে লম্বা দড়ি দিয়ে বাধা একটি ঘণ্টা সামনের অংশে ড্রাইভারের পাশে লাগানো থাকতো। কোন স্টপেজে গাড়ি থামানোর প্রয়োজন হইলে বাস কন্ট্রাক্টর সেই দড়ি টেনে ঘণ্টা বাজিয়ে ড্রাইভারকে সংকেত দিতো। বাসের ভিতর কন্ট্রাকটর চামড়া দিয়ে বানানো ব্যাগ গলায় ঝুলিয়ে ভাড়া আদায় করতো। যাত্রীরা তখন আনা,পয়সা দিয়ে ভাড়া পরিশোধ করতো।

পুরান ঢাকার রসিক মানুষেরা তখন ‘মুড়িরটিন’ নামে এই গাড়ির নাম করন করেন। তখন থেকে অদ্যাবধি এই গাড়ির নাম ‘মুড়িরটিন’ নামেই ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছে।

গাড়ি ভরা থাকলেও ড্রাইভার চলন্ত অবস্থায় ব্রেক কষে কয়েকটা খিঁচুনি দিত যাতে বেশি করে যাত্রী উঠানো যায়, আবার পথে রুহিতপুর, রামেরকান্দা, শাক্তা ও পোড়াবাড়ি যাত্রী উঠা নামার সময়েও ওরা খিঁচুনি দিত।

জিঞ্জিরা থেকে সৈয়দপুরে বাস থামার পর নৌকায় মরিচা গিয়ে আরেক বাসে,গালিমপুর ও কোমরগঞ্জ হয়ে নবাবগঞ্জ পৌঁছাতে হতো। সৈয়দপুর ও মরিচায় যা স্থানীয় ভাসায় গুদারা ঘাট বলা হতো।

সেখানে জনপ্রতি নৌকা যাত্রীদের থেকে টোল আদায় করা হতো। আশির দশকের শেষভাগে মাওয়া-ঢাকা পথে গাড়ি চলা শুরু হলে শ্রীনগর-সৈয়দপুর-ঢাকা লাইনটি দ্রুতই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, যা এখন অতীত।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker