যশোর

আজ ঐতিহাসিক যশোর মুক্ত দিবস

 আজ ৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক যশোর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল দেশের প্রাচীনতম এই জেলা। এদিন দুপুরের পরপরই যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদাররা। প্রথম শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা। যশোরেই প্রথম উঠেছিল বিজয়ী বাংলাদেশের রক্ত সূর্যখচিত গাঢ় সবুজ পতাকা।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) বৃহত্তর যশোর জেলার (যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল) উপ-অধিনায়ক রবিউল আলম জানান, ১৯৭১ সালের ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এসময় মিত্রবাহিনীও সীমান্ত এলাকা থেকে যশোর সেনানিবাসসহ পাকিস্তানী সেনাদের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান হামলা ও গোলা নিক্ষেপ করেন। এক পর্যায়ে কোণঠাসা হয়ে পাকিস্তানীরা ৫ ডিসেম্বর থেকে পলায়ন শুরু করে। যশোর সেনানিবাস ছেড়ে তারা খুলনার গিলাতলা সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। পলায়ন কালে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর শহরতলীর রাজারহাটসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়।

৬ ডিসেম্বর বিকেলের আগে যশোর সেনানিবাস খালি করে পালিয়ে যায় হানাদাররা। বিকেলে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল বারাতের নেতৃত্বে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী সেনানিবাসে প্রবেশ করে দখল নেয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত মুক্তিযোদ্ধা-জনতার ঢল নামে শহরে। পাড়া মহল্লায়ও চলে খণ্ড খণ্ড আনন্দ মিছিল। মুক্তির আনন্দে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে ফেটে পড়ে গোটা জেলার মানুষ।

এর আগে উত্তাল একাত্তরের যুদ্ধপ্রস্তুতি কালে ৩ মার্চ যশোর কালেক্টরেটের সামনে শহরের রাজপথে বের হয় জঙ্গি মিছিল। যশোরবাসী শপথ নেয় স্বাধীনতা যুদ্ধের। এই মিছিলে হানাদার বাহিনী গুলি চালালে শহীদ হন চারুবালা কর। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনিই যশোরের প্রথম শহীদ। এরপর থেকেই যশোরে সংগঠিত হতে থাকে প্রতিরোধ। নেতৃত্ব দেয় সংগ্রাম পরিষদ। সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে থাকে ছাত্র, যুবক ও নারীদের। ২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তদানীন্তন সংসদ সদস্য মশিয়ূর রহমানকে তার বাসভবন থেকে ধরে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করে।

২৯ মার্চ হানাদার বাহিনী যশোর শহর ছেড়ে সেনানিবাসে চলে যায়। ৩১ মার্চ নড়াইল থেকে হাজার হাজার লোকের এক বিশাল মিছিল শহরে আসে। শহরবাসীর সাহায্যে সশস্ত্র মিছিলটি হামলা চালায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। মুক্তি পায় সব রাজবন্দি। এর আগে ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে।

পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ অনেকেই এখানে শহীদ হন। জুলাই মাস থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহর ও অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাতে থাকেন।

যশোর মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর রণাঙ্গন। কমান্ডার ছিলেন মেজর মঞ্জুর। অন্যদিকে, এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর ১০৭ নম্বর ব্রিগেড মোতায়েন ছিল। এর কমান্ডার ছিলেন বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান। যশোর সেনানিবাস থেকে শত্রু বাহিনী ছয়টি জেলা নিয়ন্ত্রণ করতো। ২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলে অভিযান শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের শক্তিশালী ঘাঁটি চৌগাছা ঘিরে ফেলে সম্মিলিত বাহিনী। মিত্রবাহিনীর গোলার আওতায় আসে যশোর সেনানিবাস।

২২ নভেম্বর রাতে পতন হয় চৌগাছার। হানাদার বাহিনী সলুয়া বাজারে তৈরি করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি। এসময় যশোর সেনানিবাসের তিন দিকেই মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। এ অঞ্চলের পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান প্রাণভয়ে তার অফিস খুলনায় স্থানান্তর করেন। প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ অভিযান চলে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধে টিকতে না পেরে ৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায় খুলনার দিকে। মুক্ত হয় যশোর জেলা। যুদ্ধবিধ্বস্ত মুক্ত শহরে ওড়ে স্বাধীন দেশের পতাকা।

এদিকে, ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত দিবস উপলক্ষে যশোর জেলা প্রশাসন বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে। সকাল ৯টায় যশোর টাউন হল ময়দান থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker