অদম্য সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মুক্তিকামী শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীরবিক্রমের ৫১ তম শাহাদাত বার্ষিকী আজ।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়,সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান সাচনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী একটি ঘাঁটি ছিল। ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট সারা রাত থেমে থেমে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। চারদিকে কাদা আর পানি। নিঃশব্দে একদল মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে চলেছেন। এই দলে আছেন সিরাজুল ইসলাম। তাদের লক্ষ্য পাকিস্তানি সেনাদের একটি ঘাঁটি। পাকিস্তানি সেনারা কীভাবে যেন তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেল। বাংকার থেকে তারা ব্যাপক গুলি শুরু করল। আকস্মিক এ ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা হকচকিত। তারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করলেন। মুক্তিযোদ্ধারা চেষ্টা করছেন ক্রলিং করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু প্রবল গুলির কারণে তারা সামনে এগোতে পারছেন না। কিছুটা বেকায়দায় পড়েছেন। হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আর্তনাদ আর চিৎকার। গুলিতে একজন সহযোদ্ধা শহীদ এবং দুজন আহত হয়েছেন। এ অবস্থায় সিরাজুল ইসলাম সহযোদ্ধাদের আর না এগিয়ে ওই অবস্থানে থেকে গুলি চালাতে বললেন। তারপর কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে তিনি একাই ক্রলিং করে এগিয়ে চললেন শত্রুর বাংকার অভিমুখে। শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে সফলতার সঙ্গেই তিনি গ্রেনেড চার্জ করলেন। তার সফল গ্রেনেড চার্জে শত্রুর দুটি বাংকার ধ্বংস হয়ে গেল। এ ঘটনায় পাকিস্তানি সেনারা একেবারে হতবুদ্ধি। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ আরও জোরদার করলেন। এরপর পাকিস্তানি সেনারাই কোণঠাসা হয়ে পড়ল।
কিন্তু যুদ্ধ শেষে পলায়নরত পাকসেনাদের কাভারিং ফায়ারের একটি বুলেট শহীদ সিরাজের কপালে বিদ্ধ হলে তিনি গুরুতর আহত হন। মিত্র বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ভারত নেয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে টেকেরঘাটে খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়। আর তাই আজকের দিনটিই হচ্ছে শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীর প্রতীকের মৃত্যুবার্ষিকী।
হাওর টাইমসের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়, ১৯৭১ এ সময় সিরাজুল ইসলাম ১৯ বছরের টগবগে যুবক। কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র। কিন্তু লেখাপড়ায় মন বসছিল না তার। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন লাখো মানুষ। তাই মুক্তির স্বপ্নে বই-খাতা ফেলে ঘর ছাড়েন সিরাজুল ইসলাম। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে ভারতের আসামে ইকোয়ান ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ৫ নং সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। সাচনা যুদ্ধ ছাড়াও সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকায় অনেক যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন সিরাজুল ইসলাম। শহীদ সিরাজুল ইসলামের রক্তে ছিল মুক্তির নেশা। তাইতো মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিনি বাবার কাছে একটি চিঠি লিখেন। ওই চিঠিটিই হয়ে উঠে মুক্তি পাগল যোদ্ধাদের ত্যাগ আর দেশের প্রতি ভালোবাসার কালজয়ী নিদর্শন।
কালজয়ী সেই চিঠি :বাবার কাছে লেখা সিরাজুল ইসলামের চিঠিটি ছিল, ‘বাবা, আমার সালাম নিবেন, আশা করি খোদার কৃপায় ভালই আছেন। বাড়ির সকলের প্রতি আমার শ্রেণিমত সালাম ও স্নেহ রহিল। আলীরাজ, রওশন, মাতাব, রনু, ইব্রাহীম, ফুল মিয়া সকলেই একত্রে আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমার জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে জীবনের কোন মূল্য থাকিবে না। তাই যুদ্ধই জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদের ক্ষমা করিব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে। চাচা, মামাদের ও বড় ভাইয়ের নিকট আমার সালাম। বড় ভাইকে চাকরিতে যোগদান করিতে নিষেধ করিবেন। জীবনের চেয়ে চাকরি বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিলেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। দোয়া করবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখিবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্র হারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন। আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারণ নেই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সাধ মিটে যাবে। দেশবাসী স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর। মীর জাফরী করিও না। কারণ মুক্তি ফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবে না এবং বাংলায় তোমাদের জায়গা দিবে না। সালাম, দেশবাসী সালাম।’ইতি মো. সিরাজুল ইসলাম ৩০.০৭.১৯৭১।
১৯৫২ সালে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ সিরাজুল ইসলাম। বাবার নাম মরহুম মকতুল হোসেন ও মা গফুরুন্নেছা।