২ যুগ পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের ঐতিহাসিক সমাবেশ: জনসমুদ্রের উচ্ছ্বাস
অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ৭ দফা নিয়ে জামায়াতের 'জাতীয় সমাবেশ'
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ‘জাতীয় সমাবেশ’ আজ দুপুর ২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যেই উদ্যান নেতাকর্মীদের পদচারণায় জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। সারাদেশ থেকে আসা লাখ লাখ নেতাকর্মীর লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত এই সমাবেশে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দলীয় সদস্যরা।
সমাবেশের প্রস্তুতি ও পরিবেশ
ভোরের আগেই মঞ্চ নির্মাণ, অতিথিদের আসন স্থাপন, বিভিন্ন স্থানে মাইক ও বড় পর্দা স্থাপন, এবং উদ্যানজুড়ে জামায়াতের প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দুই দিকে প্রবেশ পথে বিশাল গেইট তৈরি করা হয়েছে। মধ্যরাত থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতাকর্মীরা আসা শুরু করেন।
বিশাল মঞ্চে ‘জাতীয় সমাবেশ-২০২৫’ লেখা ব্যানার টানানো হয়েছে, যার পাশেই রয়েছে দলটির প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’। মঞ্চ ও অতিথিদের জন্য সামনের অংশে লাল কার্পেট বিছানো হয়েছে। সকাল ১০টা থেকে সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী সঙ্গীত পরিবেশন করছে, যা সমাবেশস্থলে এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করেছে।
সমাবেশের মূল দাবি ও উদ্দেশ্য
জামায়াতে ইসলামী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে ৭ দফা দাবিতে এই সমাবেশ করছে। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে:
- সব গণহত্যার বিচার
- প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার
- জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন
- জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন
- সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন
- প্রবাসীদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ
- জাতীয় নির্বাচনের আগে সমতাভিত্তিক রাজনৈতিক পরিবেশ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করা
জামায়াত নেতৃত্বের প্রত্যাশা
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সমাবেশের মাধ্যমে আমরা দেশের সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবিগুলো জাতির কাছে তুলে ধরব। এই সমাবেশে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মী-সমর্থকরা আসছেন। আপনি নিশ্চয়ই দেখছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা স্মরণকালের জনসমাগম এই সমাবেশে ঘটবে। উদ্যান ছাড়িয়ে আশপাশেও মানুষের মিছিল আসছেই। ইনশাল্লাহ বেলা ২টায় আমাদের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করব।”
উল্লেখ্য, জামায়াতে ইসলামী এতদিন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনের সড়ক বা পুরানা পল্টনের মোড়ে সভা-সমাবেশ করলেও, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানো এবারই প্রথম সমাবেশ করছে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করছেন, এই সমাবেশের মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও জনসমর্থন জানান দেবে। তাদের প্রত্যাশা, সমাবেশ শুরুর আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, মৎস্যভবন সড়কসহ আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হবে।
অতিথিবৃন্দ ও স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকা
এ সমাবেশে ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী’ রাজনৈতিক দলগুলো, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্য এবং গত দেড় দশকে জামায়াতে ইসলামীর শহীদ পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মঞ্চের সামনে দুদিকে আমন্ত্রিত অতিথি, জুলাই যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য এবং জেলা আমিরদের জন্য আসন সংরক্ষিত আছে।
সমাবেশের বিভিন্ন স্থানে ৩৩টি এলইডি স্ক্রিন সেট বসানো হয়েছে যাতে নেতাকর্মীরা সরাসরি বক্তব্য শুনতে পারেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও তার আশপাশে তিন শতাধিক মাইক লাগানো হয়েছে। জামায়াতের নেতারা জানিয়েছেন, প্রায় ৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক সমাবেশস্থলে দায়িত্ব পালন করছেন।
ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে মঞ্চের পূর্ব দিকে সারি সারি অস্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ টয়লেট, নামাজের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, খাবার পানির ব্যবস্থা এবং কয়েকটি মেডিকেল কেন্দ্র খোলা হয়েছে উদ্যানের ভেতরে। সারাদেশ থেকে আসা বাস-মাইক্রোবাস পার্কিংয়ের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশ ছাড়াও মতিঝিল, কমলাপুর, কারওয়ান বাজার, পলাশীর মোড়, চানখার পুলসহ ১৩টি স্পট নির্ধারণ করা হয়েছে।
নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাস
সকাল থেকেই সোহরাওয়ার্দী অভিমুখে মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা আসছেন। তাদের কণ্ঠে স্লোগান শোনা যাচ্ছে – ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর’, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’। প্রতিটি মিছিলে এক থেকে দুটি দাঁড়িপাল্লা দেখা গেছে, তবে কোনো বাড়তি ব্যানার-ফেস্টুন নেই। কর্মী-সমর্থকরা প্রতীক সংবলিত বিভিন্ন রঙের গেঞ্জি পরেছেন এবং অনেকের হাতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা দেখা গেছে।
হবিগঞ্জ থেকে আসা সোহরাব খন্দকার বলেন, “কিছুক্ষণ আগেই ঢাকায় পৌঁছে চানখার পুল থেকে আসছি। আমাদের বিশ্বাস, একদিন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হবে। আজকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন – সেই বার্তাই আমাদেরকে উজ্জীবিত করছে, মাশাল্লাহ।”
নীলফামারী থেকে আসা জামায়াতের এক কর্মী আবদুল হাকিম জোয়ার্দার জানান, তারা ভোরবেলা ঢাকায় পৌঁছে নাস্তা করে সকাল ৮টায় মাঠে ঢুকেছেন। তিনি বলেন, “মিছিল করে আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানো ঢুকে দেখি, আমাদের অনেক আগেই অনেক ভাইয়েরা উপস্থিত হয়েছেন। মঞ্চের সামনে এবং ডানদিকে তখন কোনো স্থান খালি নেই। আমরা বামদিকে গাছের ছায়ায় স্থান পেয়েছি। আবহাওয়াটা ভালো মনে হচ্ছে। ফলে ঢাকায় আসার এই জার্নি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আগামী নির্বাচনের ভোটকে নিয়ে নেতাদের রাজনৈতিক বার্তা নিয়ে আমরা ঘরে ফিরে যাব ইনশাল্লাহ।”