বিবিধ

সাংবাদিক সিয়ামের মাথায় ৬ ছররা গুলি, অর্থাভাবে হচ্ছে না চিকিৎসা

‘তখন ভীষণ মারামারি ও গোলাগুলি হচ্ছে। ছাত্রদের লক্ষ্যকরে টিয়ারসেল ও ছররা গুলি করছিল পুলিশ। এক পর্যায়ে আবু সাঈদ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলে তাকেও পেটাতে থাকে। ওকে যখন ওয়ালের পাশে পেয়ে পুলিশ পেটাচ্ছিল তখন আমি তাকে বাঁচাতে যাই

এসময় আমার শরীর ও মাথাতেও অসংখ্য ছররা বুলেট প্রবেশ করে। তখন চিকিৎসা নিয়েছিলাম গোপনে, এখনো ৬টি ছররা গুলি আছে মাথার ভেতরে। চিকিৎসকরা বলছেন, এগুলো বের করতে না পারলে ভবিষ্যতে অনেক বড় সমস্যা হবে।’

কথাগুলো বলছিলেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (বিবিএ) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও বর্তমানে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ক্যাম্পাস প্রতিনিধি তাওহীদুল হক সিয়াম।

সিয়াম জানান, ‘আমি তখন প্রজন্ম নিউজ নামে একটি পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রতিনিধি। গত ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছিল।

দুপুর ১২ টার সময় আমি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে ক্যাম্পাসের ১ নং গেইটে নিউজ কাভার করার জন্য উপস্থিত হই। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নং গেইটে পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তাদের অবস্থান করতে দেখি।

‘শিক্ষার্থীদের মিছিল লালবাগ অভিমুখ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়েরর ১নং গেইটে অবস্থান নেয়। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে  ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের বাঁধা দেয়।

এক পর্যায়ে হাতাহাতি শুরু হয়ে পরবর্তীতে সংঘর্ষে রুপ নেয়। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ারসেল নিক্ষেপ এবং গুলি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নং গেট দখল করে নেয়। 

আবু সাঈদ দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিল। হঠাৎ কয়েকজন পুলিশ নিরস্ত্র আবু সাঈদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং লাঠি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। এমতাবস্থায় আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আবু সাঈদকে পুলিশের আঘাতের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করি।

পুলিশের লাঠির আঘাতে আবু সাঈদের মাথা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। এর চার মিনিট পর আবু সাঈদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নং গেট গুলি করে হত্যা করে পুলিশ।’

সিয়াম আরো বলেন, ‘১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে আমার শরীরের বাম দিকটি ঝাঁঝরা ও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। প্রায় ৬০টি ছররা গুলি আমার মাথা, মুখ, হাত, বাহু, পেট, কোমর এবং পায়ের বাম দিকে বিদ্ধ হয়। সে দিন রংপুর মেডিক্যালে ভর্তি হলেও পুলিশের ভয়ে আমি ডাক্তারদের না জানিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাই। তারপর আমি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমার মেসে যাই।

শরীরে থাকা অসংখ্য ছররা গুলির ব্যথা সহ্য করতে না পেরে কয়েকদিন পরে রংপুরের বেসরকারি আল মদিনা হাসপাতালে যাই। সেখানে আমার শরীরে প্রথম অস্ত্রোপচার করা হয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে চিকিৎসা করে। আবার কয়েকদিন পরে চরম গোপনীয়তা বজায় রেখে রংপুরের বেসরকারি মেডিল্যান্ড হাসপাতালে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার হয়।’

সিয়াম বলেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যে দু’টি অস্ত্রোপচার করার পরেও আমার মাথার সংবেদনশীল স্থানগুলোতে এখনো পাঁচটি ছররা রয়েছে। ফলে, আমি মাথায় সার্বক্ষণিক তীব্র ব্যথা অনুভব করি। আমার মুখ, হাত, কোমর এবং পায়ের বিভিন্ন জায়গায় অনেক গুলির স্প্রিন্টার রয়েছে।’

সিয়াম আরো বলেন, ‘এখন আমি আর মানসিক চাপ নিতে পারছি না। অসুস্থতা এবং মাথাব্যথা আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। আমি বছরের পর বছর ধরে টাকা সঞ্চয় করে আসছিলাম। কিন্তু চিকিৎসা খরচ মেটাতে আমি সেই টাকাও খরচ করে ফেলেছি।

ভবিষ্যতে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা জানি না। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন ছররাগুলি বের করতে। কিন্তু টাকার অভাবে পারছি না। চিকিৎসার টাকার জন্য জুলাই ফাউন্ডেশন যোগাযোগ করছি এখনো কোনা সহায়তা পাইনি।’

রংপুরের মেডিল্যান্ড হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জন ডা: মো. আমিনুর রহমান বলেন, ‘তার মাথার যে জায়গাগুলোতে ছররা রয়েছে, সেগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অপারেশন করা প্রয়োজন।’

সিয়াম নোয়াখালীর কম্পানিগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া গ্রামের মো. শহীদুল হকের চার ছেলের মধ্যে সবার বড়। তার অন্য তিন ভাইও পড়ালেখা করে। প্রবাসী শ্রমিক বাবার সামান্য আয় দিয়ে কোনো রকম টেনেটুনে চলে সিয়ামদের পরিবার। উন্নত চিকিৎসা করার সামর্থ নেই তাদের।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker