বিবিধ

নানা রঙে রঙিন জলচর পাখি ‘সুন্দরী হাঁস’

মহিলা হাঁস নয় কিন্তু রঙেরচ্ছটায় নাম তার সুন্দরী হাঁস। পুরুষ হাঁসের পালকে দেখা যায় নানা রং এর সমারোহ। এজন্যই পুরুষ হাঁসকে ‘সুন্দরী হাঁস’ বলে ডাকা হয়। ইংরেজি নাম ম্যান্ডারিন বা ম্যান্দারিন ডাক বাংলায় সুন্দরী (গধহফধৎরহ উঁপশ) হাঁস, বৈজ্ঞানিক নাম: Aix galericulata, অ্যানাটিডি গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত বাহারি রঙের ছোট ডুবুরি হাঁস।

ম্যান্ডারিন হাঁসের পুরুষ এবং স্ত্রী প্রজাতির দেখতে সম্পুর্ন আলাদা প্রকৃতির। এদের দেখামাত্রই পৃথক করা যায়। তবে পুরুষ প্রজাতির মান্দারিন বা ম্যান্ডারিন হাঁস পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর প্রজাতির হাঁস। চার-পাঁচ রঙের পালক দ্বারা এদের শরীর সুন্দর ভাবে সজ্জিত। এতে করে তার সম্পুর্ন লুক অনন্য দেখায়।

স্ত্রী প্রজাতির হাঁস দেখতে ধূসর বর্নের এবং দেখতে কিছুটা দেশি প্রজাতির মত। তবে এরা কোনভাবেই পুরুষ হাঁসের চেয়ে কম নয়। এরা প্রতি ঋতুতে নিজেদের সঙ্গী পরিবরর্তন করে। যে কোন এক ঋতুর জন্য নির্দিষ্ট একজন সঙ্গী থাকে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এরা এদের সঙ্গীও পরিবর্তন করে।

সঙ্গী পরিবর্তন করার এ প্রক্রিয়া শরৎকাল থেকে শুরু হয়। এরা শুধুমাত্র পুকুরের মত ছোট জলাশয়ে চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এরা লেক কিংবা ছোট ঝর্নার মত জলাশয়ে এরা সহজে যায় না। স্ত্রী প্রজাতির মাতৃকালীন সময়ে শুধুমাত্র পুকুরে বিচরন করে।

সুন্দরী হাঁস মিঠাপানির আর্দ্র ভূমি, প্লাবিত ধানক্ষেত, বনের জলধারা, পুকুর, হ্রদ ও তৃণময় জলাশয়ে বিচরণ করে। যে সব জলাশয়ের ধারেকাছে ঘন বন থাকে সেসব জলাশয় এদের পছন্দের জায়গা। সাধারণত অন্যসব প্রজাতির হাঁসের মিশ্র ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায়। এরা সামাজিক হলেও পুরুষ হাঁসেরা সচরাচর পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

এরা ভাল সাঁতারু ও দ্রুত উড়তে পারে, তবে ডুব দিতে পটু নয়। ঊষা আর গোধূলিবেলায় বেশি কর্মপটু থাকে। দিনের অন্য সময়ে ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। অন্যান্য প্রজাতির হাঁসের পা যেখানে শরীরের পেছনে অবস্থিত, সেখানে ম্যান্ডারিন হাঁসের পা তুলনামূলক সামনে অবস্থিত। সেকারণে এরা ডাঙাতেও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারে। এই সুবিধার জন্য এরা গাছের ডালেও বসতে পারে। বন্দী অবস্থায় এরা সহজেই ৬-৭ বছর বাঁচে, সর্বোচ্চ বাঁচে ১০ বছর পর্যন্ত।

সুন্দরী হাঁস অগভীর জলে মাথা ডুবিয়ে ঘাস ও লতাপাতা থেকে খাবার সংগ্রহ করে। এরা রাতেও খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে জলজ উদ্ভিদ, শস্যদানা (বিশেষত ধান), ছোট মাছ, শামুক, কেঁচো, জলজ পোকামাকড়, চিংড়ি ও কাঁকড়াজাতীয় প্রাণী এমনকি ছোট সাপ।

পুরুষ ম্যান্ডারিন হাঁস অসাধারণ সুন্দর, রঙ-চঙে এক হাঁস। এদের দৈর্ঘ্য কমবেশি ৪৪ সেন্টিমিটার, ডানা ২২.৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ২.৮ সেন্টিমিটার, পা ৩.৮ সেন্টিমিটার ও লেজ ১১ সেন্টিমিটার। ওজন ৪২৮ থেকে ৬৯৩ গ্রাম। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী ও পুরুষ হাঁসের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। পুরুষ সুন্দরী হাঁসের সারা শরীর জুড়ে নানান রঙের ছড়াছড়ি। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ হাঁসের ডানা কমলা রং ধারণ করে, ডানায় নৌকার পালের মত দু’টি খাড়া পালক থাকে। মাথা গোল, মাথার চাঁদি বাদামি, চাঁদির সামনের দিকটা নীলচে সবুজ।

চোখের উপর চওড়া সাদা ছিটা-দাগ, সাদা মোটা ভ্রূ ঘাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। গলা, ঘাড় ও চিবুক কমলা রঙের ঘন ঝালরের মত পালকে আবৃত। ঘাড়ের ও গলার বাকি অংশ ঘন নীলচে পালকে আবৃত। ডানার গোড়ায় কালো-সাদা বলয় থাকে। ডানা হালকা পাটকিলে বর্ণের। দেহতল সাদা। পিঠ, লেজ ও ডানার প্রান্তভাগের পালকগুলো কালো। ঠোঁট পিচ ফলের মত লাল, ঠোঁটের অগ্রভাগ হালকা গোলাপি। চোখ ঘন বাদামি। পা কমলা-পীতাভ বর্ণের আর লিপ্তপাদ। পায়ের পর্দাগুলো কালো।

প্রজনন ঋতু ব্যতীত অন্যান্য সময়ে পুরুষ হাঁস পুরোপুরি স্ত্রী হাঁসের মত। কেবল পিঠ চকচকে আর ঠোঁট লালচে থাকে। স্ত্রী মান্দারিনের আবার এত রঙের বাহার নেই, বেশ সাদামাটা। স্ত্রী হাঁসের পিঠ জলপাই-বাদামি, দেহতল সাদা। বগলের উপর সারি সারি সাদা ফুটফুটে দাগ। বুকে অনেকগুলো সাদা রেখা দেখা যায়। ডানার মাথার পালকগুলো নীল, তার উপর সাদা ছোপযুক্ত।

স্ত্রী হাঁসের চোখে সাদা ‘চশমা’ থাকে, চক্ষু-রেখা সাদা। ঠোঁট হলদে। এমনিতে চোখ আর পা পুরুষ হাঁসের মতোই। অপ্রাপ্তবয়স্ক হাঁসের চেহারা প্রায় স্ত্রী হাঁসের মত, তবে মাথা বাদামি আর বুকে ও বগলে বিচ্ছিন্ন সাদা ফোঁটা থাকে।

মে থেকে আগস্ট সুন্দরী হাঁস প্রজনন ঋতু। এ সময় এদের ডাকাডাকি বেড়ে যায়। পুরুষ হাঁস স্ত্রী হাঁসের মনোরঞ্জনের জন্য এক ধরনের নাচ প্রদর্শন করে। পুরুষ হাঁস ঘাড় লম্বা করে মাথা উপর-নীচ করতে থাকে এবং এক ধরনের মৃদু শব্দ করতে থাকে যা অনেকটা ঢেকুরের মত শোনায়। এছাড়া স্ত্রী হাঁসের পেছনে পেছনে ভেসে বেড়ানোর সময় পানি পানের ভান করে আর শরীর ঝাঁকায়।ঘন বনের মধ্যে জলাশয়ের কাছাকাছি এরা বাসা করে।

সাধারণত গুহায়, গর্তে বা গাছের কোটরে ঘাস, উদ্ভিদাংশ ও পালক বিছিয়ে বাসা করে। বাসার উচ্চতা মাটি থেকে কমপক্ষে ৩০ ফুট উঁচুতে হয়। মূলত স্ত্রী হাঁসই বাসা বানাবার জায়গা পছন্দ করে আর বাসা বানায়। পুরুষ হাঁস এ ব্যাপারে স্ত্রী হাঁসকে সহায়তা করে।সাধারণত একবারে ৯-১২টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো পীতাভ রঙের হয়। ডিমের মাপ ৪.৯ × ৩.৬ সেন্টিমিটার। কেবল স্ত্রী হাঁস ডিমে তা দেয়।

পুরুষ ম্যান্ডারিন এসময় আশেপাশেই থাকে আর বাসা পাহারা দেয়। ডিম ফোটার সময় হলে পুরুষ হাঁস দূরে চলে যায়। শিকারি প্রাণী বাসার কাছাকাছি এলে মা হাঁস ডেকে ডেকে তাদের দূরে সরিয়ে নেয়। ২৮-৩০ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বের হয়। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এসব ডিম ফুটে যায়। ডিম ফোটা শেষ হলে মা হাঁস মাটি থেকে ছানাদের নেমে আসার জন্য ডাক দেয়।

কোটর বা গর্ত থেকে ছানারা শূন্যে ঝাঁপ দেয় আর আশ্চর্যজনক ভাবে কোন রকম গুরুতর আঘাত ছাড়াই নিরাপদে মাটিতে নেমে আসে আর মায়ের পিছু পিছু কাছাকাছি জলাশয়ে গিয়ে নামে। এসময় পুরুষ ম্যান্ডারিন ফিরে এসে ছানা আর স্ত্রী হাঁসের সাথে মিলিত হয়। ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর ছানারা উড়তে শেখে আর নতুন ঝাঁকে গিয়ে যোগ দেয়।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker