মতামত

‘তৌহিদি জনতা’ এবং ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ – দুইটি দুর্ধর্ষ রাজনৈতিক প্রপঞ্চ

‘তৌহিদি জনতা’ এবং ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’- সাম্প্রতিক বাংলাদেশের দুটি দুর্ধর্ষ প্রপঞ্চ। গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশে এই দুটি প্রপঞ্চ ভয়াবহ রকমের বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে অসাধারণ একটি গোষ্ঠী যত্রতত্র মব সৃষ্টি করে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে।

একটু মনোযোগ দিলে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন সবই করছে কেবল শিক্ষা কার্যক্রম ব্যতীত। এই সাধারণ শিক্ষার্থীদের পরিচয় নিয়ে নানান ধরনের প্রশ্ন চলমান। এদের সাথে কি তৌহিদি জনতার কোনো এলহামি যোগসাজশ আছে? এটা নিয়ে কথা হতে পারে।

তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দানবীয় রূপ ধারণ করেছে ‘তৌহিদি জনতা’। হাসিনা পতনের পরপরই আমরা তৌহিদি জনতার কিছু টিজার, ট্রেইলার দেখলাম। রাস্তায় এক তৌহিদি যুবককে দেখলাম, লাঠি নিয়ে মহিলাদের ওপর চড়াও হয়েছে।

বিভিন্ন জমায়েতে দেখলাম কালো পতাকা উড়ছে! আমরা একটা গোষ্ঠীর আবির্ভাব নিয়ে কথা বললাম। কিন্তু আমাদেরকে বিপ্লবের (তাদের ভাষায়) স্পিরিটের বিপরীতমুখী শক্তি হিসেবে চালিয়ে দেয়া হলো।

টিজার ট্রেইলারের পর ‘তৌহিদি জনতা’ এখন পূর্ণোদ্যমে মাঠে নেমে পড়েছে। আলো-স্টারের সামনে জেয়াফত, বইমেলায় মব ক্রিয়েশন এবং সর্বশেষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে হেদায়েতি ইভটিজিং! ঠিক এরই পাশাপাশি ঢাবি ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে উঁকি মারছে একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের বেঢপ আকারের পোস্টার।

কার্জন হলের ক্লাসরুমের সামনে দেখছি হাতে লেখা খেলাফতের আহ্বান। আজ আবার মার্চ ফর খেলাফত! খেলাফত চাওয়াকে আমরা গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপট থেকে খারাপ কিছু ভাবছি না। কিন্তু এই দাবির পেছনের ক্রীড়নক কারা সেটা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। আর এটাই হচ্ছে সন্দেহ বা আপত্তির কারণ।

আমাদের সন্দেহ হচ্ছে, একটা সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে তৎপর হয়ে পড়েছে। এই ষড়যন্ত্রের শেকড় আমার ধারণা মতে কেবল বাংলাদেশের মাটিতেই নিহিত নয়। এটা বরং একটা বিরাট আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে হচ্ছে। চারদলীয় জোট সরকারের ২০০১-০৬ শাসনামলে বাংলাদেশকে এমনই সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল।

খালেদা জিয়া সরকারকে তটস্থ থাকতে হয়েছিল পুরোটা সময়। অন্যদিকে সেটার সুযোগ নিয়েছে আম্লিক ও ভারত। যার আল্টিমেট রেজাল্ট আমাদের চোখের সামনেই। প্রায় ষোলো বছরের ফ্যাসিবাদ, কালচারাল আগ্রাসন, নতজানু আঞ্চলিক সম্পর্ক, সার্বভৌমত্বের নাজুক অবস্থা, মানবাধিকার হরণ ইত্যাদি।

গণতন্ত্রহীন, ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই সময়টাতে আমরা এমনই একটা সময়ের আশঙ্কা করতাম। আম্লিক যেভাবে পলিটিক্যাল ভ্যাকুয়াম তৈরি করেছিল, রাজনীতি ও রাজনৈতিক চর্চাকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল তাতে আমাদের পূর্বাভাস ছিল একটি উগ্রবাদী শক্তির মাথাচাড়া দিয়ে উঠার ব্যাপারে।

বিভিন্ন আলাপচারিতায় অসংখ্যবার এ কথাগুলো বলেছি। যখনই মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ হয়, গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হয়, সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা ও চিন্তার ওপর খড়্গ নেমে আসে, তখনই উগ্রবাদী ও চরমপন্থী সংগঠনগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটে।

আম্লিকের বিদায়ের পর এখন রাজনৈতিক চর্চা ও চিন্তার সুযোগটা ফিরে এসেছে এটা সত্যি। কিন্তু এটাও সত্যি যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল কেন্দ্রে রাজনৈতিক শক্তি নেই।

দেশ চালানো আর দেশ গঠন কখনোই এক জিনিস নয়। দেশ গঠন একটি ভিশনারি পদক্ষেপ, যেখানে রাজনৈতিক চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটে।

এর ফলে রাষ্ট্রের প্রতিটি ফাংশনাল ফোরামে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েম হয় এবং প্রচলিত বহুজনের রাজনীতির আকাঙ্খার বাস্তবায়ন ঘটে। ফলে খুব সহজেই বিচ্ছিন্ন শক্তিগুলোকে চিহ্নিত করা যায় এবং মাথাচাড়া দিয়ে যাতে না উঠতে পারে সেই পথটিও সুগম হয়।

স্পষ্টভাবেই বলছি, রাষ্ট্র চালাতে রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন। রাষ্ট্র কোনো এনজিও, বিদ্যালয় বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান নয়। রাষ্ট্র একটি সার্বভৌম সত্ত্বা। এর উপাদান হচ্ছে- ভূমি ও মানুষ। ভূমি ও মানুষের ভাষা বুঝতে হলে রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি থাকা আবশ্যক।

অরাজনৈতিক চক্রের মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকলে বহুমতের বাইরের বিচ্ছিন্ন শক্তি সেই সুযোগ লুফে নিবেই। এদের পেছনে ফুয়েল দিতে থাকা বহিরাগত শক্তিরও অভাব নেই।

আমরা জানি, তারা কারা! বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে কাদের বেশি লাভ, সেটা কারও অজানা থাকার কথা নয়। সুতরাং এই অন্ধকার আরও ঘনীভূত না হতেই রাষ্ট্রে তার চালিকাশক্তি তথা রাজনীতির ইনক্লুশন জরুরি। কেবলমাত্র রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্ব ঘুচানোর মাধ্যমেই রাষ্ট্রকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের চক্রব্যূহ থেকে বের করে আনা সম্ভব।

লেখক: ফারহান আরিফ
যুগ্ম সাধারন সম্পাদক
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, কেন্দ্রীয় সংসদ।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker