মতামত

নয়া বাংলাদেশ-আমেরিকা সম্পর্ক উন্নয়নের পথ কার হাতে

জাহিদ হোসাইন খান ⚫

গ্রেটেস্ট কামব্যাক হিসেবে পুনরায় ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পরই বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার আগমন নিয়ে সবাই নানা জল্পনা-কল্পনায় ছিল। জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একের পর এক রাজনৈতিক চমক তৈরি করছেন ট্রাম্প। জলবায়ু পরিবর্তনসহ ইউক্রেন যুক্ত, মধ্যপ্রাচ্য সংকটে নিজের উপস্থিতি দারুণভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প কেমন আচরণ করবেন তার অপেক্ষায় আছেন। তার ভাষ্যে, এর আগে আমরা তাকে ‘ওয়ান পয়েন্ট জিরো’ চরিত্রে দেখেছি। কিন্তু তাকে ‘টু পয়েন্ট জিরোতে’ দেখিনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ। এই সংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র। তিনি ট্রাম্পের নতুন সরকারের হেলথ ও হিউম্যান সার্ভিস বিভাগের সেক্রেটারি হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন।

কেনেডি পরিবার ও বাংলাদেশ সংযোগ
যুক্তরাষ্ট্রে কেনেডি পরিবার অনেক প্রভাবশালী। এই পরিবারের দুই সন্তান সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও সিনেটর এডওয়ার্ড মুর কেনেডি। এডওয়ার্ড মুর কেনেডি টেড কেনেডি নামে পরিচিত। টেড কেনেডি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালের আগস্টে তিনি ভারতের কলকাতার শরনার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ককে উদযাপন করতে কেনেডি পরিবারের সদস্যরা ২০২২ সালে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। টেড কেনেডির সন্তান টেড কেনেডি জুনিয়র বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। টেড জুনিয়র তখন একাত্তরে বাংলাদেশ বিষয়ে ভুল পক্ষ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র বলে মন্তব্য করেন।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র তৎকালিন সরকার যখন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, সে সময় মুক্তিকামী বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দেশটির সিনেটর প্রয়াত এডওয়ার্ড এম কেনেডি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে মতামত তৈরিতে কাজ করেছিলেন তিনি। সিনেটর এডওয়ার্ড মুর কেনেডির ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর মার্কিন সিনেটে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশিদের ওপর গণহত্যার বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান নেন।

ট্রাম্প কার্ড রবার্ট এফ কেনেডি
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও সিনেটর এডওয়ার্ড মুর কেনেডির ভাই রবার্ট এফ কেনেডি। তার সন্তান রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র। তাকে বাংলাদেশের মানুষের একবারেন না চেনার কারণ নেই। রবার্ট গত দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী আলাপে বেশ উল্লেখযোগ্য ও পরিচিত এক নাম।

রবার্ট পেশায় পরিবেশবাদী আইনজীবী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন। প্রথম দিকে জো বাইডেনের পুনর্নির্বাচনকে সমর্থন করেন তিনি। এরপর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। একাধিক বিতর্কের কারণে নির্বাচনি দৌড় থেকে ছিটকে যান। শেষপর্যন্ত রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন দেন। নির্বাচনি প্রচারণার সময় ‘মেক আমেরিকা হেলদি এগেন’ নামে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার উদ্যোগের নেতৃত্ব দেন।

বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্ক বেশ ভালো। রবার্টকে সেন্টারস ফর ডিসিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’(সিডিসি) ও ফুড অ্যান্ড ড্রাগ সেফ্টি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতো জনস্বাস্থ্য সংস্থার কাজে ভূমিকা রাখতে দেখা যেতে পারে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ট্রাম্প গত বছর নির্বাচনী সমাবেশে ঘোষণা করেছিলেন, আমি তাকে (কেনেডি জুনিয়র) খাদ্য ও ওষুধ নিয়ে অবাধে কাজ করার সুযোগ দেব। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কেনেডি জুনিয়র ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করতে চান বলে জানা গেছে। রবার্ট এফ কেনেডি হতে পারে বাংলাদেশ ২.০ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প ২.০ সরকারের মধ্যে সংযোগ। বিভিন্ন লবিস্ট গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনে সক্রিয়, সেখানে রবার্ট এফ কেনেডি ও কেনেডি পরিবার বাংলাদেশের জন্য কোনো সুযোগ হতে পারে কি না তা নিয়ে পেশাদার কূটনীতিকরা কাজ করতে পারেন।

ট্রাম্পের আমলে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সংযোগ বৃদ্ধি
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ রয়েছে। এ সম্পর্কের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত ব্যাপক, বিশেষ করে প্রযুক্তি, শিক্ষা, মানবাধিকার, সাইবার সন্ত্রাস এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ এবং ব্যবসার সুযোগ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বাজার হতে পারে। বিশেষভাবে স্টারলিংকসহ বিভিন্ন আধুনিক সেবা বাংলাদেশের বাজারে চালু করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টারনেট সেবা এবং ডিজিটাল টেকনোলজির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের পেপ্যাল অর্থ আদান-প্রদান সেবা চালুর আবেদন রয়েছে। পেপ্যাল চালু করা যেতে পারে দেশে।

মানবিক সংযোগ বৃদ্ধির সুযোগ
যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য এক শক্তিশালী সংযোগের সুযোগ তৈরি করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম সরকারের সময়েও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রে ছিল উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ট্রাম্প ২.০ সরকারের সময় দুই দেশের মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণার সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে মানবপাচার প্রতিরোধে কার্যকরী সহযোগিতা তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশে মানবপাচারের বিরুদ্ধে কাজ করছে অনেক সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রও এই সমস্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিকভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। এ বিষয়ে যৌথ কার্যক্রম বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সাইবার সন্ত্রাস ও অর্থপাচারের মতো গুরুতর অপরাধে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে কাজের সুযোগ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী আইনি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বিনিময়ের মাধ্যমে এসব অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। বিশেষত বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতামূলক উপস্থিতি বাড়ানো যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বন্ধন উন্নয়নে বেশ কিছু সুযোগ রয়েছে। আমেরিকান সেন্টার ও ইএমকে সেন্টারসহ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে বিভিন্ন কাজ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে ট্রাম্পকে আমন্ত্রণ
বেশ আগে এক টিভি অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক নিয়ে আলাপ করতে দেখা যায়। তার পরনে তখন বাংলাদেশের তৈরি শার্ট ছিল। বাংলাদেশ নামটি ট্রাম্পের কাছে নিশ্চয়ই পরিচিত। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বাংলাদেশ ভ্রমণের আহ্বান করতে পারে। এর আগে আমরা দেখেছি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন ভারত সফর করলেও বাংলাদেশে পা রাখেননি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সফর দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে সাহায্য করবে এবং একাধিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশের নতুন সরকারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। এ সম্পর্কের মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতা নয় বরং নিরাপত্তা, শিক্ষা, পরিবেশ ও মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। ইউএসএআইডিসহ অন্যান্য সংস্থার কাজের পরিধি বাড়ানো এবং স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আরও কার্যকরী হতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার এই সুযোগ বাংলাদেশের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। 

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker