মতামত

ভিক্ষাবৃত্তির চেয়েও ঘৃণ্য: ঘুষ ও চাঁদাবাজি কেন সমাজের জন্য বেশি ক্ষতিকর?

ধর্মীয় নীতি ও দর্শনের আলোকে ঘুষ ও চাঁদাবাজিকে ভিক্ষাবৃত্তির চেয়েও নিন্দনীয় ও ক্ষতিকর কাজ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা সমাজের নৈতিক ভিত্তি ও ন্যায়বিচারকে ধ্বংস করে।

চাঁদাবাজি এবং ঘুষের মতো কাজগুলো যে ভিক্ষাবৃত্তির চেয়েও বেশি ঘৃণ্য, এই বিষয়টি বিভিন্ন ধর্মীয় নীতি এবং দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলো দুর্নীতি, শোষণ এবং অন্যায্য উপার্জনের কঠোর নিন্দা করে, অন্যদিকে অভাবী মানুষের প্রতি সহানুভূতি এবং দানকে উৎসাহিত করে।

চাঁদাবাজি ও ঘুষ: সক্রিয় শোষণ এবং সামাজিক ক্ষয়

চাঁদাবাজি হলো বলপ্রয়োগ, হুমকি বা ভয়ভীতি দেখিয়ে অবৈধভাবে অর্থ বা সম্পদ আদায় করা। এই প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যকে জিম্মি করে বা তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার ভয় দেখিয়ে লাভবান হয়। চাঁদাবাজি মানুষের মনে ভীতি এবং নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। এটি সরাসরি মানুষের সম্পত্তির অধিকার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার গুরুতর লঙ্ঘন।

ঘুষ হলো অবৈধ সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে কোনো কর্মকর্তা বা ব্যক্তিকে অর্থ বা মূল্যবান কিছু প্রদান করা। ঘুষ সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। ঘুষের কারণে মেধা বা যোগ্যতার বদলে অর্থের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা ন্যায়বিচারকে ধ্বংস করে দেয়। এটি সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করে এবং সমাজ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে।

ভিক্ষাবৃত্তি হলো দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের নিষ্ক্রিয় (passive) অসহায়ত্ব, যা কেবল টিকে থাকার একটি উপায়। এর বিপরীতে, চাঁদাবাজি এবং ঘুষ হলো সক্রিয় (active) শোষণ, যেখানে অন্যকে জিম্মি করে বা প্রতারণার মাধ্যমে লাভ করা হয়। এই কাজগুলো সমাজের স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহকে ব্যাহত করে, অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ায় এবং মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়। সুতরাং, চাঁদাবাজি এবং ঘুষ শুধু মাত্র ব্যক্তি নয়, বরং গোটা সমাজ ব্যবস্থার জন্য এক অমার্জনীয় অপরাধ, যা ভিক্ষাবৃত্তির চেয়ে অনেক বেশি নিন্দনীয় এবং ক্ষতিকর।

ধর্মের দৃষ্টিতে মৌলিক পার্থক্য

ধর্মের দৃষ্টিতে এই তিনটি কাজের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে: ভিক্ষাবৃত্তি সাধারণত অসহায়ত্বের কারণে উদ্ভূত, আর চাঁদাবাজি ও ঘুষ হলো লোভ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত সক্রিয় অন্যায়। সকল প্রধান ধর্মেই চাঁদাবাজি এবং ঘুষকে গুরুতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই কাজগুলো মানুষের সৎ জীবনযাপন, ন্যায়বিচার এবং নৈতিকতার মূল ভিত্তি নষ্ট করে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ:

  • ইসলাম: ইসলামে ঘুষ নেওয়া এবং দেওয়া উভয়ই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। হাদিসে আছে, ঘুষদাতা এবং ঘুষ গ্রহীতা উভয়ের ওপরই আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়। চাঁদাবাজি (জুলুম) অন্যের অধিকার হরণ করার সমতুল্য, যা একটি বড় গুনাহ।
  • হিন্দুধর্ম: হিন্দু ধর্মে ‘Dharma’ (নৈতিক দায়িত্ব) এবং ‘Adharma’ (অনৈতিকতা) এর মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। ঘুষ এবং শোষণ ‘অধর্ম’-এর অংশ, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
  • খ্রিষ্টধর্ম: বাইবেলে লোভ, দুর্নীতি এবং শোষণের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন আধ্যাত্মিক জীবনে বাধা সৃষ্টি করে এবং ঈশ্বরের চোখে তা নিন্দনীয়।

দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ নৈতিকভাবে অপবিত্র এবং এটি সামাজিক ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করে। এটি কেবল আইন নয়, বরং ধর্মীয় অনুশাসনও লঙ্ঘন করে।

ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি

অন্যদিকে, ধর্মগুলো সাধারণত ভিক্ষাবৃত্তিকে চরম দারিদ্র্য এবং অসহায়ত্বের ফল হিসেবে দেখে। যদিও কিছু ধর্ম (যেমন ইসলাম) কর্মঠ ব্যক্তিকে অকারণে ভিক্ষা করতে নিরুৎসাহিত করে, তবুও তারা অভাবী মানুষের প্রতি করুণা এবং দানশীলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। সকল ধর্মেই দরিদ্রদের প্রতি দান এবং সাহায্যকে একটি মহৎ গুণ হিসেবে ধরা হয় (যেমন: যাকাত, সাদকা, দান)। ভিক্ষা করাকে সাধারণত কোনো সক্রিয় অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না; বরং এটি একটি পরিস্থিতি, যা সমাজের সহানুভূতির দাবি রাখে।

ভিক্ষাবৃত্তি হলো এমন এক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি তার প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম হয়ে অন্যের কাছে সাহায্যের আবেদন করে। এখানে কোনো জবরদস্তি বা শঠতা থাকে না।

উপসংহার

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, চাঁদাবাজি এবং ঘুষের ঘৃণ্যতার মূল কারণ হলো লোভ (Greed) এবং ক্ষমতার অপব্যবহার (Abuse of Power)। এই কাজগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের ক্ষতি সাধন করে এবং সমাজকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। অন্যদিকে, ভিক্ষাবৃত্তি হলো অসহায়ত্বের (helplessness) ফল। একজন ভিক্ষুক অন্যদের শোষণ করছে না, বরং সে নিজেই তার পরিস্থিতির শিকার। তাই, ধর্মীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী, চাঁদাবাজি ও ঘুষের মাধ্যমে যে আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক ক্ষতি সাধিত হয়, তা ভিক্ষাবৃত্তির চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর। এটি কেবল অর্থের বিষয় নয়, এটি ন্যায়বিচার, সততা এবং মানবিকতার মৌলিক ধর্মীয় আদর্শের লঙ্ঘন।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker