তেলে ভিজে একাকার সাংবাদিকতা: নেপথ্যের কারণ ও প্রভাব
স্বার্থান্বেষী সাংবাদিকতা পেশার সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে; পেশাদাররা বিব্রত
সাংবাদিকতা একসময় দেশ ও দশের স্বার্থে নিবেদিত একটি মহৎ পেশা হিসেবে বিবেচিত হলেও, বর্তমানে কিছু সাংবাদিকের মধ্যে ‘তেলবাজি’র প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। লেখক **মাহফুজ রাজা** তার এক কলামে এই প্রবণতাকে ‘তেলে ভিজে পিচ্ছিল সাংবাদিকতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, কিছু সাংবাদিক মূল পেশা থেকে সরে গিয়ে রীতিমতো ‘তেলের দোকান’ খুলে বসেছেন, যারা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নিয়োগপ্রাপ্তের মতো আচরণ করছেন। এর ফলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের হাজারো ব্যর্থতা তাদের ‘তেলের নিচে’ চাপা পড়ে যাচ্ছে।
লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, এই মাত্রাতিরিক্ত তেলবাজির কারণে সাধারণ মানুষ যে ঠকছেন, সেই কথিত সাংবাদিক সাহেবরা কি তা উপলব্ধি করেন? ব্যক্তিগত সামান্য কিছু সুবিধার জন্য তারা নিজেদের পেশাদারিত্বকে বিসর্জন দিচ্ছেন। তবে, উপজেলা পর্যায়গুলোতে যেমন ভালো মানের পেশাদার সাংবাদিক রয়েছেন, তেমনি কিছু তথাকথিত প্রবীণ বা পেশাদার সাংবাদিকও নিজেদের স্বার্থের কাছে ‘বিক্রি’ করে দিচ্ছেন।
নেপোলিয়ন ও সমালোচকদের গুরুত্ব
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উদাহরণ টেনে লেখক বলেছেন, নেপোলিয়ন নিজেই মনে করতেন তার ভুল হতে পারে এবং সমালোচকরাই তার বড় বন্ধু। অন্যদিকে, যারা বন্দনা বা চাটুকারি করে, তারা হচ্ছে বড় শত্রু। প্রকৃতপক্ষে, নিজেকে জাহির করা বা সার্বক্ষণিক আত্মপ্রচার সবসময় সুফল বয়ে আনে না, বরং তুমুল সমালোচনার জন্ম দেয়। মানুষ এমনও ভাবতে পারে যে, নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই বুঝি এতো প্রচার আয়োজন। কিছু সাংবাদিকের প্রশাসন বা কর্তা-ভিত্তিক সংবাদ প্রচারও তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের ইঙ্গিত দেয়।
কলামিস্ট **এস এম মিজানুর রহমান মামুন** একান্ত আলাপচারিতায় বলেন, “সাংবাদিকতা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পেশা, এ পেশা কোনো আমলার দাসত্ব করার জন্য নয়! যারা পেশাকে দাসত্বে আবদ্ধ করেছে তারা কখনোই কোনো কালে সাংবাদিক ছিল না, এরা সাংবাদিক নামধারী স্বার্থান্বেষী। সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকা মূলধারার সাংবাদিকদের উচিত এসব অবাঞ্ছিত সাংবাদিকদের বয়কট করা।”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রসঙ্গ
ঊনিশ শতকের বিখ্যাত লেখক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ রচনার প্রসঙ্গ টেনে লেখক বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে এর সামঞ্জস্য তুলে ধরেছেন। শাস্ত্রীর মতে, মানুষ সমাজে পারস্পরিক ‘তৈল মর্দন কর্ম’ করে থাকে অতি উৎসাহে নিজ প্রয়োজন ও স্বার্থে। এই ‘তৈল’ প্রয়োগের বিষয়টি সাংবাদিকতা পেশার কিছু অংশেও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সাংবাদিকতা: সমাজের দর্পণ ও বর্তমান চিত্র
সাংবাদিকদের সমাজের দর্পণ বলা হয়; তারা সমাজের যেকোনো অন্যায়, অত্যাচার বা শোষণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের প্রতিবেদন মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়, এমনকি অনেক বড় বড় রথি-মহারথীদের চাল উল্টে দিতে পারে এবং ক্ষমতাবান শাসকের ক্ষমতা কেড়ে নিতেও ভূমিকা রাখে। সাধারণ জনগণ সংবাদ মাধ্যমকে তাদের যাপিত জীবনে অন্যতম শক্তি হিসেবে দেখে এসেছে এবং এখনও দেখতে চায়।
তবে, কিছু সিনিয়র-জুনিয়র সাংবাদিকদের চাটুকারিতায় এমনো দেখা যায় যে, দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিরা এক শতাংশ কাজ করলেও স্বার্থান্বেষী সাংবাদিকদের প্রচারে মনে হয় সেই কর্তা ব্যক্তি বুঝি পিরামিড জয় করেছে। সুনির্দিষ্ট কর্মের বাইরে অতিরিক্ত বন্দনা, কর্তাদের সিদ্ধান্তের গুণকীর্তন, গলা ডুবিয়ে সমর্থন— এসব চাটুকার সাংবাদিকরা লজ্জা না পেলেও পেশাদার সংবাদিকরা লজ্জা পাচ্ছেন। কর্তারা এই তেলের খুশি হলেও, ৯৯ শতাংশ মানুষ এতে বিব্রত হচ্ছেন এবং সারা দেশের মানুষ তাদের চাটুকারিতায় হাসছে।
পেশার বাইরে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে যেকোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থনের অধিকার রয়েছে। কিন্তু কিছু পেশাদার সাংবাদিক মনে করছেন, শাসক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক শক্তির করুণা, পদ-পদবী, সরকারি জমি, কিছু বরাদ্দ বা বিজ্ঞাপনের কারণে চক্ষু-লজ্জার মাথা খেয়ে ডিউটিকালীন সময়ে তারা চাটুকারিতা করছেন। সারাদেশের মানুষ তাদের এই নির্লজ্জ আচরণের সাক্ষী হচ্ছেন জেনেও তারা ‘তেলের বন্যা’ বইয়ে দিচ্ছেন।