মতামত

দামে ধস : আলু চাষিদের রক্ষার উপায় কী?

বাজারে আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। প্রতি কেজি আলু মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। খামার পর্যায়ে কৃষক আলুর দাম পাচ্ছেন প্রতি কেজি ১০ থেকে ১২ টাকা। অথচ আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি।

কৃষি বিপণন বিভাগের হিসাব অনুসারে এবার আলুর উৎপাদন খরচ হলো প্রতি কেজি ১৪ টাকা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত কৃষকদের খরচের পরিমাণ কেজিতে ১৮ থেকে ২০ টাকা। সে ক্ষেত্রে সামান্য মুনাফা যোগ করে খামার প্রান্তে আলুর সর্বনিম্ন দাম হওয়া উচিত প্রতি কেজি ২২ টাকা। কিন্তু এখন বিক্রি হচ্ছে তার অর্ধেক দামে। ফলে মারাত্মক এক আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছেন দেশের আলু চাষিরা। তাঁরা এর প্রতিবাদ করছেন। স্মারকলিপি দিয়েছেন। রাস্তায় আলু ফেলে এ বঞ্চনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

সরকারি তথ্য অনুসারে গত বছর (২০২৩-২৪) আলু উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি চার লাখ টন। অনেকের মতে ওই পরিসংখ্যান ছিল অতিমূল্যায়িত। প্রকৃত উৎপাদন ছিল তার অনেক কম, ৮৫ থেকে ৯০ লাখ টন। ফলে বাজারে আলুর সরবরাহ ছিল কম। আবহাওয়ার বৈপরীত্য ও বন্যার কারণে গত বছর বিভিন্ন শাক-সবজির উৎপাদন হ্রাস পায়।

তাতে দ্রুত বেড়ে যায় আলুসহ শাক-সবজির দাম। এক পর্যায়ে বিদেশ থেকে আলু আমদানি করেও মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো যায়নি। বাজারে আলু বিক্রি হয়েছিল ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে। তাতে দেশের কৃষকরা অনুপ্রাণিত হয়ে এবার আলুর আবাদ বাড়িয়েছেন। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদনও ভালো হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাব মতে, এবার আলুর চাষ হয়েছে ৫.২৪ লাখ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় তা ১৫ শতাংশ বেশি। এবারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও তা ১২ শতাংশ বেশি। মোট উৎপাদন হবে প্রায় এক কোটি ২০ থেকে ২৫ লাখ টন। আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা, বীজ, অপচয় ও রপ্তানি মিলে মোট প্রয়োজন ৯০ লাখ টন আলু।

তাতে এবার উদ্বৃত্ত হবে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টন। ফলে বাজারজাত উদ্বৃত্ত অনেক বেশি হওয়ায় উৎপাদন মৌসুমে আলুর ব্যাপক মূল্যহ্রাস ঘটেছে। এ অবস্থায় আলু সংরক্ষণের সুবিধা কম থাকায় এবং কৃষকদের উৎপাদন খরচ মেটানো ও ঋণ পরিশোধে চাপ থাকায় কম দামেই আলু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা।

দেশের হিমাগারগুলো এরই মধ্যে আলুতে প্রায় ভরে গেছে। এ ক্ষেত্রে প্রান্তিক চাষি ও প্রকৃত কৃষকদের হিস্যা খুবই কম। তাঁরা আলু সংরক্ষণের জন্য হিমাগারের মালিকদের কাছ থেকে স্লিপ বা অনুমতি পাচ্ছেন না। যাঁরা স্লিপ সংগ্রহ করতে পেরেছেন তাঁদের হিমাগারের রাস্তায় আলুর বস্তাসহ লাইন ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য।

তা ছাড়া এবার হিমাগারের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে মালিকপক্ষ। আগে যেখানে কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকা দিতে হতো হিমাগারে, এবার তা বাড়িয়ে করা হয়েছে আট টাকা। তাতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন আলু চাষিরা। কৃষি বিপণন বিভাগ এর মধ্যস্থতা করে এখন দাম বেঁধে দিয়েছে কেজি প্রতি সাত টাকা ৭৫ পয়সা। তাতেও কৃষকদের আপত্তি। কারণ তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে হিমাগারে আলু নিয়ে যাওয়ার পরিবহন খরচ ও শ্রমিকদের মজুরি।

এ পরিস্থিতিতে কৃষকদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার। বর্তমান উৎপাদন মৌসুমে ভর্তুকি মূল্যে ১০ থেকে ১২ লাখ টন আলু সংগ্রহ করে হিমাগারে মজুদ করে রাখতে পারে। পরে যখন দাম বেড়ে যাবে তখন খোলাবাজারে তা বিক্রি করতে পারে। তাতে আলুর দাম স্থিতিশীল থাকবে। তা ছাড়া হিমাগারে আলু সংরক্ষণের নিমিত্তে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ন্যূনপক্ষে ৩০ শতাংশ জায়গা সংরক্ষিত রাখার ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে।

একই সঙ্গে হিমাগার ভাড়ার ক্ষেত্রে প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কেজিতে দুই টাকা করে ভর্তুকি দিতে পারে সরকার। শুধু আলু নয়, পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটোর ক্ষেত্রেও উৎপাদন মৌসুমে সরকারিভাবে ন্যূনপক্ষে ১০ শতাংশ উৎপাদিত পণ্য যৌক্তিক মূল্যে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এবার ওই পণ্যগুলোর ক্ষেত্রেও খামার প্রান্তে দামে ধস নেমেছে। উৎপাদন মৌসুম গেলে এগুলোর দাম অনেক বেড়ে যাবে।

আলুর বাজারে বর্তমান মূল্য ধস ঠেকানোর অন্যতম উপায় হচ্ছে বিদেশে আলু রপ্তানি। গত প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। কিন্তু এর পরিমাণ তেমন বেশি নয়। ২০১০-১১ সালে বাংলাদেশ থেকে টাটকা আলু রপ্তানি হয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৯ টন। গত বছর ছিল মাত্র ১২ হাজার টন। এবার এরই মধ্যে তা ৩০ হাজার টন ছাড়িয়ে গেছে। আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকার ১০ শতাংশ হারে নগদ ভর্তুকি দিচ্ছে।

তার পরও মোট রপ্তানির পরিমাণ আমাদের মোট উৎপাদনের ১ শতাংশের অর্ধেকের চেয়ে কম। বৈশ্বিক আলু উৎপাদনে এখন বাংলাদেশের শরিকানা ২.৭ শতাংশ। সমগ্র বিশ্বে আলুর স্টার্চ এবং ফ্লেকসংক্রান্ত বাণিজ্যের পরিমাণ এখন প্রায় ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতিবছর শতকরা ১০ ভাগ হারে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশকে এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের ভাগীদার হতে হবে ভবিষ্যতে। এর জন্য দেশের অভ্যন্তরে প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশ সাধন করা একান্ত দরকার।

আলু রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য ভালো জাতের ও গুণগত মানের আলু উৎপাদন করতে হবে কৃষকদের। বর্তমানে বাংলাদেশে অবমুক্ত প্রায় ৪০টি জাতের উন্নত আলুর চাষাবাদ হচ্ছে কৃষক পর্যায়ে। উচ্চ ফলনশীল জাতের আলুবীজ সম্প্রসারিত হয়েছে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি আবাদি এলাকায়। কিন্তু কৃষক পর্যায়ে প্রত্যায়িত বীজ ব্যবহারের হার মাত্র ১০ শতাংশ। বাকি ৯০ শতাংশ অপ্রত্যায়িত।

ভালো খামার ব্যবস্থাপনা, যথাযথ পর্যায়ে উপকরণ ব্যবহার, রোগ প্রতিরোধ, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সম্পর্কিত ভালো ধ্যান-ধারণার ঘাটতি আছে কৃষকদের। এর জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে তাঁদের। এ ছাড়া ভালোভাবে প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেটজাতকরণ ও সংরক্ষণ অবকাঠামোর উন্নয়ন সাধন করতে হবে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ টন আলু পচে যায় কিংবা রোগবালাই ও পোকার আক্রমণে এদের মান নষ্ট হয়ে যায়। এই অপচয় হ্রাস করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় খাদ্য আলু। নিউজিল্যান্ড ও হল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক দেশে আলুই মানুষের প্রধান খাবার। কিন্তু আমাদের দেশে মানুষের খাদ্য তালিকায় আলুর নাম প্রায়ই থাকে অনুপস্থিত। দেশের মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন, ভোগ ও বিতরণের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে যে হিসাব দেওয়া হয় তাতেও আলু সম্পর্কে কোনো পরিসংখ্যান থাকে না। এ দেশে আলুর পরিচিতি মূলত সবজি হিসেবে।

সাধারণভাবে আলুকে আমরা কখনোই প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করিনি। এ দেশে এর ব্যবহার মূলত সহযোগী খাদ্য হিসেবে। ভাতের বিকল্প হিসেবে ‘রোস্টেড পটেটো’, সিদ্ধ আলু কিংবা আলুর চিপস জনসাধারণের মাঝে এখনো জনপ্রিয় হওয়ার অপেক্ষায় আছে। একে উৎসাহিত করা দরকার।

আদিকালে আলুর ব্যবহার ছিল পশুখাদ্য হিসেবে। এর আদি নিবাস ছিল পেরু। ১৫৭০ সালে এর বিস্তার ঘটে স্পেনে। অতঃপর ১৬০০ সালে এর আবাদ ছড়িয়ে পড়ে ইতালি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানিসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। ১৯৭৫ সালে ইংল্যান্ডের কৃষি বিভাগ একটি পুস্তিকা বের করে, যার শিরোনাম ছিল ‘আলু ভালোবাসুন, আলুর ব্যবহার বৃদ্ধি করুন’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট নিরসনকল্পে মানুষের খাদ্য হিসেবে আলুর কদর বেড়ে যায়। গোল আলু এবং মিষ্টি আলু দুটোই যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর খাদ্যসংকট মোকাবেলায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। যেকোনো জমিতে অতি অল্প পরিচর্যায় আলু ফলানো সম্ভব। অন্য যেকোনো শস্যের চেয়ে আলুর ফলন বেশি।

মুনাফাও বেশি। এতে অনেক পুষ্টির উপাদানও বিদ্যামান। এসব কারণে বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আলু। এর আবাদ বাড়ছে । বাড়ছে উৎপাদন। এর জন্য স্থায়িত্বশীল নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। কৃষকদের জন্য নীতি সহায়তা ও আর্থিক সমর্থন প্রদান করা দরকার।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker