জাতীয়

প্রশ্ন ফাঁস কাণ্ড : ময়েজ ‘জামায়াতের ডাক্তার’, জনি-রনি সাবেক ছাত্রদল নেতা

পেশায় তারা চিকিৎসক, আবার কেউ কোচিং সেন্টারের মালিক। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার অন্তত ১০ বার প্রশ্ন ফাঁস করেছে চক্রটি। এর মধ্য দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

গত ৩০ জুলাই থেকে ১০ দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত এমন সাত চিকিৎসকসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

এদের মধ্যে কেউ ‘জামায়াতের ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত। কয়েকজন ছাত্রদলের সাবেক পদধারী নেতা আছেন বলে জানিয়েছেন সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া। রবিবার (১৩ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির সদর দপ্তরের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব তথ্য জানান।

সিআইডির প্রধান বলেন, দেশের মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে নিয়মিত প্রশ্ন ফাঁসকারী বিশাল এক সিন্ডিকেটের খোঁজ পায় সিআইডির সাইবার পুলিশ।

২০২০ সালে মিরপুর মডেল থানায় করা এক মামলায় সম্প্রতি চক্রের অন্তত ৮০ জন সক্রিয় সদস্য বিগত প্রায় ১৬ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। প্রশ্ন ফাঁস করে মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পেয়েছে সিআইডি। এর মধ্যে অনেকে পাস করে ডাক্তারও হয়েছেন। তাদের সবাই বিভিন্ন মেডিক্যাল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্ন ফাঁস করতেন।
 
প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া বলে জানিয়েছে সিআইডি। তার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলেও জানান সিআইডি প্রধান।সংবাদ সম্মেলনে মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ‘মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁস চক্রে জড়িত চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন আহমেদ ও সোহেলী জামান সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী।

ময়েজ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে প্রশ্ন ফাঁসে জড়ান। তার মাধ্যমে শত শত শিক্ষার্থী অবৈধভাবে মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছে। প্রশ্নফাঁস ও মানি লন্ডারিং মামলার আসামি এই ময়েজ চিহ্নিত ছাত্রশিবির নেতা এবং পরবর্তী সময়ে জামায়াতের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। তার স্ত্রী সোহেলী জামান (৪০) প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য। তিনি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ডাক্তার।’ 

২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে এই প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান গ্রেপ্তার চিকিৎসক মো. আবু রায়হান। প্রাইভেট কোচিং সেন্টার চালাতেন। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্র্যাকটিস করেন। আরেক চিকিৎসক জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮) স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে ‘থ্রি-ডক্টরস নামক’ কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে শোভন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে র‌্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। 

শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদলের পদধারী নেতা ছিলেন বলেও জানায় সিআইডি। এ ছাড়া গ্রেপ্তার চিকিৎসক মো. জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮) ‘মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের’ মালিক। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রে জড়িত। 

সিআইডির দাবি, তিনি নামকরা বিভিন্ন ডাক্তারের সন্তানদের প্রশ্ন ফাঁস করে মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি মূলত মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রের মূল হোতা ও বর্তমানে কারাগারে থাকা জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী।
এই ব্যবসা করে দামি গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংকে নগদ অর্থসহ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করান। জনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক।

সিআইডি প্রধান জানান, চিকিৎসক জিলুর হাসান রনি (৩৭) জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল (নিটোর) একজন ডাক্তার। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হন। ২০১৫ সালের মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় র‌্যাবের হাতে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে রংপুর থেকে গ্রেপ্তার হন। রংপুর মেডিক্যালে অধ্যয়নকালে ছাত্রদল নেতা ছিলেন। বর্তমানে ড্যাবের সঙ্গে জড়িত এবং আহত বিএনপি নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত দলের একজন চিকিৎসক। 

গ্রেপ্তার চিকিৎসক ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২) বাবা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। বেসরকারি কমিউনিটি ব্যাজড মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে পাস করেন। ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলের আকুর-টাকুরপাড়ায় নিজ শ্বশুরবাড়িতে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পড়িয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে মেডিক্যালে ভর্তি করান।

সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮) মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতা জসীমের বড় ভাই ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের মেশিনম্যান সালামের খালাতো ভাই। তিনি নিজে আলাদা একটি চক্র চালাতেন। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। রওশন আলী হিমু (৪৫) চক্রের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পুরনো সহযোগী। রওশন আলী হিমু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিমু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আক্তারুজ্জামান তুষার (৪৩) মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর। ই-হক নামে কোচিং সেন্টার চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। ২০১৫ সালে র‌্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিল। জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী (৪৫) মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসিমের পুরনো সহচর। ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। প্রাইমেট, থ্রি ডক্টরসসহ বিভিন্ন মেডিক্যাল কোচিং সেন্টারে ফাঁসকৃত প্রশ্ন সরবরাহ করতেন।

গ্রেপ্তার আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩) টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন। মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁসের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার কলিকে ভর্তির মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান। এরপর ছেলে ইমরুল কায়েস হিমেলকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্ন ফাঁসের এক সিন্ডিকেট। জসীমের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল কুদ্দুসের। জসীমও ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিয়মিত টাঙ্গাইল যেতেন।

এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৯টি মোবাইল ফোন, চারটি ল্যাপটপ, নগদ দুই লাখ ১১ হাজার টাকা, ১৫ হাজার এক শ বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যাংকের ১৫টি চেক বই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ভর্তির অ্যাডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker