জাতীয়

বেনাপোল চেকপোস্টে বিজিবির বাঁশের বেড়ায় শতাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবরুদ্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা

বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্টের সামনে বিজিবির বাঁশের বেড়া দিয়ে চৌধুরী মার্কেটসহ শতাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ৬ মাস ধরে অবরুদ্ধ। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা, তবে বিজিবি নিরাপত্তা ও চোরাচালান রোধের কথা বলছে।

বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোষ্টে বাঁশের বেড়া দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে চৌধুরী মার্কেট নামের একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এই বাঁশের বেড়া দিয়ে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মার্কেট ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা:

তৃতীয় তলা বিশিষ্ট এই মার্কেটে প্রায় শতাধিক দোকানপাট রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কয়েকটি পরিবহন ব্যবসায়ীদের কাউন্টার, আবাসিক হোটেল, কম্পিউটার-ফটোকপি দোকান, মানিচেঞ্জার, খাদ্য দ্রব্য ও পানীয় জাতীয় দোকান, ট্রান্সপোর্ট ও সিএন্ডএফ এজেন্ট অফিস। বাঁশের বেড়া দিয়ে মার্কেটটি অবরুদ্ধ রাখায় লোকজন প্রবেশ করতে না পেরে এখানকার ব্যবসায়ীরা বেকার হয়ে পড়ছেন এবং তাদের পরিবার পরিজন নিয়েও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অবরুদ্ধের প্রতিবাদ জানিয়ে পরিত্রাণ পেতে বিভিন্ন মহলে আবেদন জানিয়েছেন ভুক্তভোগী মার্কেট মালিকসহ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।

Image

বিজিবির দাবি ও ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন:

তবে বিজিবির দাবি, পাসপোর্টধারী ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের গতিরোধ করতে তারা মার্কেটের সামনে বাঁশের বেরিকেট দিয়ে রেখেছেন। জানা যায়, গত ৬ মাস আগে বিজিবি এই বাঁশের বেড়া দিয়ে মার্কেটটি অবরুদ্ধ করে। বিজিবি বলছে, সাধারণ পাবলিক যাতে এদিকে না আসতে পারে তার জন্য এই বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলেছেন, “বেড়া যদি দিতেই হবে তাহলে এত টাকা বেতন দিয়ে ঢাল তলোয়ার নিয়ে এখানে বিজিবির সদস্যদের পাহারা দেওয়ার কি প্রয়োজন এবং রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের ট্যাক্সের এত টাকা পয়সা কেন ব্যয় করা হয়?”

তারা আরও বলেন, “কোন যুক্তিতে যশোর-কলকাতা মহাসড়কে উপর বাঁশের বেড়া দিয়ে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অবরুদ্ধ কেন করা হয়েছে জানি না। এতে যাতায়াত ও বাণিজ্যিক ক্ষতি হচ্ছে।” ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, “আগের মত সীমান্তের চোরাচালান প্রতিরোধে তেমন কোন সফলতা আমরা পত্রিকায় টেলিভিশনে দেখি না। তবে ইদানিং দেখা যায় প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে ৫০ লাখ পর্যন্ত টাকার পণ্য আটক দেখায় বিজিবি। আসলে এটা কোন চোরাচালান এর মাধ্যমে আসে না। এসব পণ্য আসে পাসপোর্টযাত্রীদের মাধ্যমে।”

Image

পাসপোর্টযাত্রী ও তল্লাশির ভোগান্তি:

পাসপোর্টযাত্রীদের সাথে আনা মাদক, ভারতীয় শাড়ী, থ্রী-পিচ, কম্বল, বিভিন্ন প্রকার চকলেট, ফুসকা, জিরা, কিসমিস, তৈরী পোষাক, খাদ্য সামগ্রী, বিভিন্ন প্রকার ঔষধ এবং কসমেটিক্স সামগ্রী আটক দেখায় বিজিবি। শুধু তাই নয় তারা যাত্রীদের একাধিকবার তল্লাশি করে। প্রথমে ভারত থেকে প্রবেশের সময় বিজিবি সদস্যরা তাদের নিজস্ব স্ক্যানিংয়ে যাচাই বাছাই করে। এরপর সেই যাত্রী বেনাপোল চেকপোষ্ট কাস্টমস স্ক্যানিং অতিক্রম করলে বাইরে স্থল বন্দরের যাত্রী টার্মিনালের নীচে আবারও তল্লাশি করে। এরপর আবার ওই যাত্রীকে পাঠানো হয় চেকপোস্ট বিজিবি’র আইসিপি ক্যাম্পে। সেখান থেকে আসার পর ইজিবাইকে বাজারের দিকে গাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে গেলে পথে বিজিবি সদস্যরা ইজিবাইক দাঁড় করিয়ে তল্লাশি করে। এরপর আবার গাড়িতে উঠার পর আমড়াখালী নামক বিজিবি চেকপোষ্টে ওই একই পাসপোর্টযাত্রীদের তল্লাশি করা হয়।

বেনাপোল চেকপোষ্টের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি পরিবহনের ব্যবস্থাপক বলেন, “বিজিবি প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের সামনে টেবিল পেতে ৭/৮ জন, তারপর রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকে আরো ৩/৪ জন। এত সদস্য কেন-কি-কারনে পাসপোর্টযাত্রী তল্লাশি করতে লাগে তা আমার বোধগম্য নয়। তাহলে কাস্টমস সদস্য ও কাস্টমস গোয়েন্দা কেন লাগে? রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের টাকা ব্যয় করে এত সরকারী সংস্থায় কেন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়?”

খুলনার পাসপোর্টযাত্রী অনিমা রায় জানান, চিকিৎসা শেষে তিনি বাংলাদেশে আসলে মাত্র ৫ কিলোমিটার পথের মধ্যে ৬ জায়গায় তার ব্যাগ খুলে তল্লাশি করা হয়

Image

ব্যবসায়ী ও সমিতির ক্ষোভ:

অবরুদ্ধ ওই মার্কেটের ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন বলেন, “বাঁশের বেড়া দেওয়ার জন্য আমার দোকানে খরিদ্দার আসছে না। বিজিবি কয়েকবার বেড়া খুলে ফেলার আশ্বাস দিলেও তারা কথা দিয়ে কথা রাখছে না।”

ওই মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ী তৌহিদুর রহমান জানান, তিনি বৈধ ব্যবসার মাধ্যমে সরকারকে বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব দেন। তবে বিজিবি তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে বাঁশের বেড়া দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখায় বাণিজ্যিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। অনেক বার বিজিবিকে বাঁশের বেড়া পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন জানালেও তারা কর্ণপাত করছেন না। এটি দুঃখজনক।

চৌধুরী সুপার মার্কেটের মালিক দুলাল হোসেন চৌধুরী জানান, বেনাপোল স্থলবন্দর চেকপোষ্ট প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের সামনে চৌধুরী সুপার মার্কেট নামে তার একটি মার্কেট রয়েছে। যেখানে শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। হঠাৎ করে ৬ মাস আগে যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক ফারজিন ফাহিম ভারত থেকে আসা পাসপোর্টধারী ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের যাতায়াত বন্ধের কথা বলে মার্কেটের সামনে বাঁশের বেড়া দিয়ে মার্কেটটি এক প্রকার অবরুদ্ধ করে দেয়। এসময় তিনি ও মার্কেটের ব্যবসায়ীরা আপত্তি জানালে বিজিবি কর্মকর্তা বলেন, দুদিন পর বেড়া সরিয়ে নিবেন। কিন্তু ৬ মাস হতে চলল এখন পর্যন্ত তিনি বাঁশের বেড়া সরিয়ে নেননি। এতে নাগরিক ও মৌলিক অধিকার হরণ করে মানুষ চলাচলের রাস্তা মহাসড়কে বাঁশের বেড়ায় বাণিজ্যিক ক্ষতির পাশাপাশি সড়কের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। বেড়া সরানোর দাবি জানিয়ে একাধিকবার অনুরোধ জানালেও কোন ধরনের কর্ণপাত করছে না বিজিবি কতৃপক্ষ। বিজিবির অবৈধ এই বাঁশের বেড়া দ্রুত সরিয়ে যাতে মানুষের ব্যবসা, বাণিজ্য ও চলাচলের পরিবেশ তৈরী করে দেওয়া হয় তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সহযোগীতা কামনা করেন।

বেনাপোল চেকপোস্ট ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি জি এম আশরাফ বলেন, “এই বেড়া বিজিবির খামখেয়ালী ছাড়া আর কিছু না। দেশি-বিদেশি পাসপোর্টযাত্রী এ পথে যাতায়াত করে। পাসপোর্টযাত্রীদের সাথে তো কোন চোরাচালানি পার হয় না। আর যদি তেমন পার হওয়ার কোন সুযোগ থাকে তাহলে তার জন্য তো বিজিবির মূল ফটকে স্ক্যানিং মেশিন এবং সদস্যরা আসা যাওয়ার দুই পাশে রয়েছে। সরাসরি প্রধান সড়কের উপর একই যাত্রীর ব্যাগ কয়েকবার তল্লাশি করে নাজেহাল করা হচ্ছে বৈধ পাসপোর্টযাত্রীদের।”

চেকপোস্ট ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা আব্দুল মালেক জানান, বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোষ্ট দিয়ে দেশী-বিদেশী মানুষের আসা যাওয়া। কিন্তু সীমান্তের ৮ কিলোমিটার বিজিবি তাদের দাবি করে চোরাচালান প্রতিরোধের নামে প্রধান সড়কে বাঁশের বেড়া দিয়ে গরুর খাটালের মত অবস্থা করে রেখেছে। তারা ব্যবসায়ীদের সাথে কোন পরামর্শ না করে এভাবে বাঁশের বেড়া অন্য প্রতিষ্ঠানের সামনে দিতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে বিজিবির সাথে কথা বলা হলেও কর্ণপাত করছেন না। সড়কের উপর বাঁশের বেড়া না দিয়ে নিরাপত্তার বিষয়ে আরো দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করার আহবান জানান এ ব্যবসায়ী নেতা।

চেকপোষ্ট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আজিজুল হক বলেন, “বিজিবি চৌধুরী মার্কেটের সামনে বাঁশের বেড়া দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা অবরুদ্ধ হয়ে আছে। তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা পরিচালনা করতে না পারায় ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিদের উপর ক্ষুব্ধ।”

গণমাধ্যমকর্মী আনিসুর রহমান জানান, “পৃথিবীর কোন দেশে বাঁশের বেড়া দিয়ে পাসপোর্টধারীদের গতিরোধ বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অবরুদ্ধের নজির নেই। ব্যবসায়ীদের মতামত না নিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানের সামনে বাঁশের বেড়া দেওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। যদি বাঁশের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে তাহলে বিজিবি সদস্যদের চেকপোষ্টে কাজটা কি?”

বিজিবির বক্তব্য:

যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, “নিরাপত্তাজনিত কারণে অল্প কিছু জায়গায় বাঁশের বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া এই জায়গায় সম্প্রতি চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনাসহ ল্যাগেজ পার্টির দৌরাত্ব কমাতে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।”

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker