ইতিহাস ও ঐতিহ্যকিশোরগঞ্জ

ভ্যাপসা গরমে নিকলীর তালপাখার বেড়েছে কদর

“তোমার হাত পাখার বাতাসে… আমার প্রাণ জুড়িয়ে আসে” গরমের আরামে হাতপাখা যুগ যুগ ধরে এক অনন্য মাধ্যম। পাখার উপযোগিতা নিয়ে এখনও বাংলা সিনেমার এই গানটি হৃদয় ছুয়ে যায়। এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় গরমের দাপট বেশি। প্রখর রোদে ভ্যাপসা গরমে যখন গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসাবে দেখা দেয় লোডশেডিং, তখন মানুষের প্রাণ হয়ে যায় ওষ্ঠাগত। এমন সময় শরীর জুড়াতে অনেকেরই ভরসা হয়ে উঠে হাতপাখা।

সেই তালপাতার তৈরি হাতপাখার সাথে জড়িয়ে আছে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দামপাড়ার প্রায় দুই শ’ পরিবারের জীবন-জীবিকা। দামপাড়া ইউনিয়নের দুটি গ্রামের নারীদের তৈরি তালপাতার হাতপাখায় ঘোরে সংসারের চাকা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দুই গ্রামের অন্তত ৩৪ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে শুরু হয় নারীদের সংগ্রাম। সংসারের চাকা ঘোরাতে অনেকে বেছে নেন তালপাতার হাতপাখা বানানোর কাজ।

এখানকার হাতপাখা যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।প্রতিবছরের চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে তালপাখার চাহিদা বেড়ে যায়। তখন নিকলীর দামপাড়ার নোয়ারহাটি, টেকপাড়া ও বর্মনপাড়ায় ঘরে ঘরে পাখা তৈরির ধুম পড়ে।

সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কারিগররা বাড়ির উঠানজুড়ে দল বেধে হাতপাখা তৈরির কাজ করেন। তবে এই তিন মাসের তালপাখার বাজারকে কেন্দ্র করে কারিগরদের ব্যস্ততা থাকে বছরের অন্য সময়ও। এবার লোডশেডিং বেশি থাকায় এবং প্রচণ্ড গরমের কারণে তালপাখার চাহিদাও বেড়েছে। সারাদেশে যাচ্ছে নিকলীর হাতপাখা।

গ্রামের ভানুমতি সূত্রধর (৭৮) বলেন, ‘৫০ থেকে ৬০ বছর অইবো আমরা হাতপাখা তৈরির কাজ করতাছি। ৭১ সালে এই গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে। তহন আমাদের অনেকের স্বামীরে মাইরা ফালায়। আমরা বিপদে পইরা যাই। তহন কী কইরা চলবাম। এই কাজ কইরাই আমরা সংসার চালায়া আইতাছি। এহন আমার পুতের বউ, নাতিরাও এই কাজ করে।’

Image

গ্রামে তালপাখা তৈরির কাজটা করেন মূলত নারীরাই। পুরুষেরা শুধু সরঞ্জাম এনে দেন। বাড়ির শিশুরা উঠানে বসে নারীদের হাতপাখা তৈরির কাজে সহযোগিতা করে।বংশপরম্পরায় এ গ্রামে এখনো কিশোর-তরুণ বয়সীরা পাখা তৈরির পেশা বেছে নিচ্ছে।

গ্রামের প্রবীণ কারিগররা জানান, স্বাধীনতার আগে একটি পাখা তৈরিতে খরচ হতো আট আনা। বিক্রি হতো এক থেকে দেড় টাকায়। এখন একটি পাখা তৈরিতে গড়ে খরচ পড়ে ৫০ টাকা। বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৭৫ টাকা টাকায়। পাংখা বিক্রি করতে বাজারে নেয়া লাগে না। পাইকাররা বাড়িত থেকে এসে নিয়া যায়।’

পাখার কারিগর মনসা বর্মন (৪২) বলেন, একটা পাংখা বানাইতে প্লাস্টিক লাগে, জালি বেত লাগে, তালপাতা লাগে, এরপরে বাঁশ লাগে, চুঙ্গি লাগে। এসব দিয়ে তৈরি করতে হয়। সবশেষে রং দেওন লাগে। রং না দিলে বেশি সুন্দর হয় না তাই বেশি চলে না।’

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker