সত্যজিৎ রায়,তিনি ছিলেন সুকুমার রায়ের ছেলে। সুকুমার রায়ের পিতা ছিলেন উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী । তিন জনই ছিলেন বিশ্ব বরেন্য ব্যাক্তিত্ব।ইতিহাসের খাতায় স্বর্ণাক্ষরে মূদ্রিত হয়েছে তাদের নাম।তাদের বাড়ী কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলাধীন মসূয়া গ্রামে।
ইতিহাস থেকে জানা যায় তাদের এক পূর্বপুরুষ শ্রী রামসুন্দর দেব চাকদহ গ্রামে ভারতের নদীয়া জেলায় বসবাস করতেন। ভাগ্যের ঘুর্নিপাকে তিনি পূর্ববঙ্গের শেরপুরে গমন করেন৷ শেরপুরের জমিদার বাড়িতে তার সাথে সাক্ষাৎ হয় কিশোরগঞ্জ সদরের যশোদলের জমিদার রাজা গুণীচন্দ্রের ৷ রাজা গুণীচন্দ্র রামসুন্দরের সুন্দর চেহারা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয় বিচক্ষণতার মায়ায় আকৃষ্ট হয় এবং রামসুন্দরকে সঙ্গে করে কিশোরগঞ্জ সদরের যশোদলে জমিদারিতে নিয়ে যান৷ যশোদলে নিয়ে গিয়ে বাড়ি ঘরসহ সম্পত্তি উপহার দিয়ে রামসুন্দরকে তার জামাতা বানান৷ সেই থেকে রামসুন্দর যশোদলে বসবাস শুরু করেন ক্লান্তিহীন ভাবে৷ তার বংশধররা সেখান থেকে সরে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদী সংলগ্ন কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে কালাতিপাত শুরু করেন।
সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় এবং বাবা সুকুমার রায় দুজনেরই জন্ম হয়েছিল এখানে।লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক, প্রকাশক ও শখের জ্যোতির্বিদ উপেন্দ্রকিশোরের মূল পরিচিতি ১৯শ শতকের বাংলার এক ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম নেতা হিসেবে। উপেন্দ্রকিশোরের ছেলে সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ননসেন্স ও শিশু সাহিত্যের সেরা লেখকদের একজন। দক্ষ চিত্রকর ও সমালোচক হিসেবেও সুকুমারের খ্যাতি ছিল তুমুল। সুকুমার রায়ের একমাত্র সন্তান সত্যজিৎ রায়। সত্যজিতের মাত্র তিন বছর বয়সেই বাবা সুকুমারের মৃত্যু ঘটে; মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাকে বড় করতে সক্ষম হয়।
সত্যজিৎ রায় ছিলেন, একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক এবং লেখক। তাকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালের ২ মে, কলকাতা শহরে সাহিত্য ও শিল্প সমাজে খ্যাতনামা রায় পরিবারে। তার পূর্বপুরুষের বাড়ী কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে।
মসূয়া গ্রামে জীর্ণতা সম্বলিত লতা পাতা জড়ানো বাড়ির পরিচিতি বাংলার অমিমাংসিত প্রতিভা সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ী হিসেবে।
জানা যায় – উক্ত বাড়ীতে বর্তমানে মানব শুণ্য, কেউই থাকেন না ঐতিহাসিক এই বাড়ীতে। অথচ কোনএকসময় এই বাড়িটিকে বলা হত”পূর্ব বাংলার জোড়াঁ সাকোঁ”
দেখা যায়- এই ঐতিহাসিক বাড়িটির পূর্বে রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট, কয়েক একর জায়গা জুড়ে পশ্চিমে বাড়ি, পূর্বে প্রাচীর ও সিংহ দরজা ছিল যা সময়ের কষাঘাতে নেই। পশ্চিমে জরাজীর্ণ ভবন, যা এখন ভূমি অফিস। তার একটু পশ্চিমে গেলেই ডাকঘর। বাড়ির ভিতরে রয়েছে কারুকার্য খচিত প্রাচীন দালান, বাগানবাড়ি, হাতীর পুকুর, খেলার মাঠ ইত্যাদি।
যানা যায়-বাড়িটি এখন সরকারের রাজস্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে আছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্দোগে ২০১২ সালে ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি রেস্ট হাউজসহ বাড়ির সীমানা প্রাচীর ও রাস্তাঘাট সংস্কার করা হয়।
প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী। তাঁর বাবার নাম ছিল কালীনাথ রায়। পাঁচ বছর বয়সে নিঃসন্তান চাচা জমিদার হরি কিশোর রায় চৌধুরী তাঁকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।তার পিতা তাকে ডাকতো কামদারঞ্জন নামে। পিতার দেয়া কামদারঞ্জন রায় নাম বদলিয়ে রাখেন উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী। কিন্তু দত্তক পুত্র গ্রহণের বেশ ক‘বছর পর হরি কিশোর রায় চৌধুরী ঔরসে নরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী জন্মগ্রহণ করায় দত্তক পুত্র উপেন্দ্র কিশোরের গুরুত্ব কমতে থাকে। হরি কিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন জমিদার।
অন্যদিকে হরি কিশোর রায় চৌধুরী ভবিষ্যতে সম্পদের উত্তরাধিকার নিয়ে ঔরসজাত পুত্র ও দত্তক পুত্রের মাঝে যাতে কোন সংঘাত না বাধে তাই বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে নকশা করে লোহার খুঁটি দিয়ে দত্তক পুত্রের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা বাড়ীর সীমানা নির্ধারণ করে নেন। লোহার খুঁটিগুলো আজও রয়েছে কালের স্বাক্ষী হয়ে।
সীমানা নির্ধারিত বাড়িতে উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর উরসে ১৮৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন জ্যেষ্ঠ পুত্র সত্যজিৎ রায়ের পিতা শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়। জন্মের পরই সুকুমার রায়সহ উপেন্দ্র কিশোর চলে যান কলকাতায়। মাঝে মাঝে নিজ বাড়িতে ছেলে মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে আসতেন তিনি।
হরি কিশোর রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী মসুয়ায় জমিদারী লাভ করেন। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী হয়ে পড়েন কলকাতা কেন্দ্রিক। নাতি সত্যজিৎ রায়ের জন্ম কলকাতাতেই এবং বেড়ে ওঠা সবই হয়েছে কলকাতায়।
ভাঙ্গা-চোরা মলিন, সত্যজিৎ রায়ের এই পৈতৃক বাড়িটি দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে। বাড়িটি রাজস্ব বিভাগের দখলে।
সবাই জানে এটি সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি। এ অঞ্চলের মানুষ মনে প্রাণে এখনও ধরে রেখেছেন সেই বিশ্ববরেণ্য অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ঐতিহাসিক পৈতৃক বাড়িটি। প্রতি বছর ঐতিহাসিক বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখী মেলা। পরিদর্শনে আসেন প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী কবি-সাহিত্যিক এক কথায় কোমলপ্রাণ মানুষ।
ঐতিহাসিক হাওর -বাওরে ঘেরা বাংলার রুপ কুমারী কিশোরগঞ্জের মহা ব্যাক্তিত্ব তালিকার গৌরবান্বিত তালিকার উজ্জ্বল তারকারাজির সমন্বয় উল্লিখিত এই পরিবার তথা মানুষজন।