কিশোরগঞ্জস্বাস্থ্য

আক্রান্তের হার গরমে: গবাদিপশুর এলএসডি রোগ ছোঁয়াচে

অধিকাংশ গবাদিপশু বর্তমানে লাম্পি স্কিন ডিজিজ এ আক্রান্ত, গবাদিপশুর এ রোগটি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। লাম্পি স্কিন ডিজিজ গরুর জন্য একটি ভয়ংকর ভাইরাস জনিত রোগ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সব জায়গায় গবাদি পশু এলএসডি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এই রোগ খামারের জন্য বড় ধরণের ক্ষতির কারণ। বর্তমানে একটি খামার কে অর্থনৈতিকভাবে লোকসান এনে দেওয়ার জন্য এফএমডি বা ক্ষুরা রোগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর রোগ হিসাবে ধরা হয় এটিকে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে এ রোগের সংক্রমণ খুব বেশি,সরেজমিনে 

উপজেলার একটি গ্রামে পল্লী চিকিৎসক নাহিদ হাসান মুন্নাকে দেখা যায়, গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজের চিকিৎসা দিচ্ছেন মনোযোগ সহকারে।ডাক্তার মুন্নার মতে গরুর জন্য এটা কঠিন যন্ত্রণাদায়ক রোগ,অবলা এই চতুষ্পদ প্রাণী ডাক্তার পেয়ে যেন আপনজন পেয়েছে,বোবা প্রাণীটি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।একটু শান্তির সংস্পর্শ যদি পাওয়া যায়।

জানা যায়, প্রধাণত বর্ষার শেষে, শরতের শুরুতে বা বসন্তের শুরুতে যে সময়ে মশা মাছি অধিক বংশবিস্তার করে সে সময়ে প্রাণঘাতী এই রোগটি ব্যপক ভাবে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।

উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে খুঁজ খবর নিয়ে জানা যায়,সাম্প্রতিক কালে রোগাক্রান্ত শতকরা ৬০-৭০ ভাগ গবাদিপশু এই রোগে আক্রান্ত। সরেজমিন তত্ত্ব মতে,কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর এবং প্রতিবেশী এলাকা ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও পাগলা থানার চর আলগি,দিগিরপাড়,আমাটিয়া,দুগাছিয়া প্রভৃতি গ্রামেও এ রোগের সংক্রমণ লক্ষ করা যায়,হোসেনপুর সাহেবের চরের অলেক মিয়া,আরাফাত, চরকাটিহারীর সামিম,গফরগাঁও এর চরআলগির কাঞ্চন, রশিদ,পাগলা এর নরেশ, মাসুমসহ প্রত্যেকের  এক বা একাধিক গরুই এ রোগে আক্রান্ত। 

লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাস রোগের কারণ:

এক প্রকার পক্স ভাইরাস বা এলএসডি ভাইরাসের সংক্রমণে গবাদি পশু এই রোগে আক্রান্ত হয়। এবং মশা-মাছির মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে।

এলএসডি আক্রান্ত রোগের লক্ষণ:

  • আক্রান্ত গরু প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং খাবার রুচি কমে যায়।
  • জ্বরের সাথে সাথে মুখ দিয়ে এবং নাক দিয়ে লালা বের হয়। পা ফুলে যায়। সামনের দু’পায়ের মাঝ স্থান  পানি  জমে যায়।
  • শরীরের বিভিন্ন জায়গা চামড়া পিণ্ড আকৃতি ধারণ করে, লোম উঠে যায় এবং ক্ষত সৃষ্ট হয়। ধারাবাহিকভাবে এই ক্ষত শরীরের অন্যান্য জায়গা ছড়িয়ে পড়ে।
  • ক্ষত মুখের মধ্যে, পায়ে এবং অন্যান্য জায়গা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  • ক্ষত স্থান থেকে রক্তপাত হতে পারে। শরীরে কোথায় ফুলে যায় যা ফেটে টুকরা মাংসের মতো বের  হয়ে  ক্ষত হয়, পুঁজ কষানি বের  হয়।
  • পাকস্থলী অথবা মুখের ভেতরে সৃষ্ট ক্ষতের কারণে গরু পানি পানে অনীহা প্রকাশ করে এবং খাদ্য গ্রহণ কমে যায়।

লাম্পি স্কিন ডিজিজ হলে করনীয়:

বিশেষজ্ঞদের মতে,LSD (Lampy Skin Disease) দ্রুত ছোঁয়াছে এক প্রকার ভাইরাস ঘটিত রোগ।প্রতিদিন 50+50=100 গ্রাম খাবার সোডা ও নিম পাতা খাওয়াতে হবে।জ্বর থাকলে ফাস্ট ভেট ও কিটোভেট ট্যাবলেট দিন।ফিটকিরি ও পটাশ ও নিম পাতা সিদ্ধ পানি দিয়ে ওয়াশ করুন,মশা মাছি মুক্ত রাখুন,সুস্থ্য গরু থেকে আলাদা রাখুন।এ সময় লিভার টনিক,জিংক সিরাপ ও ডিসিপি পাউডার দিলে গরু এই রোগের সাথে লড়াই করতে অধিক সাপোর্ট পেয়ে থাকে।

লাম্পি স্কিন ডিজিজ চিকিৎসা:

ভাইরাসজনিত রোগ তাই এর বিশেষ কোন চিকিৎসা নেই। তবে ভালোভাবে পরিচর্যা সহ কিছু ব্যবস্থা নিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

আক্রান্ত পশুর ২য় পর্যায়ের ব্যকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধে এন্টিবায়োটিক যেমন ট্রাইজেক্ট ভেট ইনজেকশন/ ট্রাইজন ভেট ইনজেকশন ইত্যাদি ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পাড়ে।

জ্বর নিরাময় ও ব্যথা উপশমের জন্য ব্যথানাশক যেমন টাফনিল ভেট বোলাস / ইনজেকশন ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বায়োলাক্ট বোলাস/ টিএমটি ভেট বোলাস নিয়মিত খাওয়ানো উচিৎ।

ডাইইউরেটিক্স হিসাবে লুমিক্স (Lumix Sol.) ঔষধ মুখে সেবন করালে ভালো উপকার পাওয়া যায়।

অটোজেনাস ভ্যাকসিন এবং পাশাপাশি অটোহিমোথেরাপি দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

রোগ প্রতিরোধের উপায়:

গরুকে নিয়মিত এল এস ডি ভ্যাকসিন দিতে হবে।খামারের ভিতর এবং আসে পাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যেন মশা মাছির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ খুব কম হয়।

আক্রান্ত খামারে যাতায়ত বন্ধ করতে হবে এবং আক্রান্ত খামার বা সেড থেকে আনা কোন উপকরণ অথবা খাদ্য ব্যবহার যাবে না।

এলএসডি তে আক্রান্ত গরুকে শেড থেকে আলাদা করে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যাতে মশা মাছি কামড়াতে না পারে।

এলএসডি তে আক্রান্ত গভীর দুধ বাছুরকে খেতে না দিয়ে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দিতে হবে।

গরু বা মহিষে এল এস ডি আক্রান্তের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারী ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে।

এআইএসের সূত্র মতে জানা যায়,১৯২৯ জাম্বিয়া প্রথম অফিসিয়ালি শনাক্ত হওয়া এই রোগ ১৯৪৩ সাল থেকে ৪৫ সালের মধ্যে মহাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়ের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, মোজাম্বিকসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে হাজার হাজার গরু আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং শত শত খামার বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে সত্তর এবং আশির দশকে আফ্রিকার প্রায় সব দেশের গরু এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং হাজার হাজার খামার বন্ধ হয়ে যায় অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পল্লি চিকিৎসক নাহিদ হাসান মুন্না জানান, আমার ব্যাক্তিগত জরিপে সাম্প্রতিক কালে শতকরা ৬০-৭০ ভাগ গরু এ রোগে আক্রান্ত হোসেনপুর সহ আশপাশ এলাকায়। গরু পালনকারী, কৃষক বা খামারী প্রত্যেককে সচেতন থাকা জরুরি। খামার বা গরুর ঘর কিম্বা ঘরের আশপাশ পরিষ্কার রাখা বাঞ্ছনীয়। গবাদিপশু পালনকারী বা খামারী ভাই বোনদের উদ্দেশ্যে বলবো রেজিস্টার ভেটেনারি ডাক্তারের পরামর্শ ও সচেতনতাই পারে বড় ধরণের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে। 

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker