বিশ্ব

যে কারণে মানবিক বিরতির চাপ দিচ্ছেন বাইডেন

ইসরায়েলের বিমান হামলায় বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতি দিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বনেতাদের আহ্বান উপেক্ষিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে সবাইকে চমকে দিয়ে গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস ঘোষণা দেয়, গাজায় ত্রাণ প্রবেশ ও বেসামরিক লোকজনকে সরে যাওয়ার সুযোগ দিতে প্রতিদিন চার ঘণ্টা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল। যদিও পরের দিনও এটি কার্যকর হতে দেখা যায়নি। পর্যবেক্ষকদের মতে, ইসরায়েলকে সাময়িক হলেও যুদ্ধবিরতিতে রাজি করানোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব দেখাতে মরিয়া ওয়াশিংটন।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য সফরকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন সাময়িক যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলকে রাজি করাতে চেষ্টা করেন। কয়েকবার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মুখেও শোনা গেছে এ কথা। তবে গাজায় ইসরায়েলের হামাসবিরোধী অভিযান সমর্থন করার পরও সাময়িক মানবিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে জো বাইডেন হঠাৎ কেন ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে বেশ চাপ দিচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী, শক্তিশালী ও নিশ্চিত কৌশলগত অংশীদার ইসরায়েল।

দুই দেশের প্রশাসনের কখনো কখনো মতবিরোধ হলেও এই স্থায়ী অবস্থান পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম। তবে কৌশলগত আরব অংশীদারদেরও পাশে চায় ওয়াশিংটন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নেয় ইসরায়েল, সৌদি আরব, কুয়েত ও আরব উপদ্বীপের অন্যান্য দেশ। অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ছিল সিরিয়া, মিসর, ইরাক ও লিবিয়া।

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭৮ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে মিসরকে পশ্চিমাদের দিকে নিয়ে আসা মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের অন্যতম প্রধান কৌশলগত বিজয়। রেজা শাহ পাহলভির আমলে ইরানও ছিল কট্টর যুক্তরাষ্ট্রপন্থী। তবে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর ঘনিষ্ঠ মিত্র থেকে রাতারাতি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে ওঠে তেহরান। এরপর ইরানে আক্রমণ করতে প্রতিবেশী ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে সাহায্য করে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের পরোক্ষ মদদে প্রায় ১০ বছর ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইরাক।

এরপর মুজাহিদদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে আরেকটি ছায়া যুদ্ধে জড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। স্নায়ুযুদ্ধ প্রায়ই ছোট দেশগুলোর স্বার্থের পরিপন্থী হলেও দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্থার কিছু কৌশলগত সুবিধা ছিল। বড় দুই পরাশক্তির হস্তক্ষেপে আঞ্চলিক সমস্যাগুলো বড় ধরনের যুদ্ধে পরিণত হয়নি। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন হলে পশ্চিমারা বিশ্বাস করতে শুরু করে তারা সবচেয়ে বড় কৌশলগত যুদ্ধে জয় পেয়ে গেছে। ভবিষ্যতের বৈশ্বিক সংঘাতগুলো খুব বেশি গুরুতর হবে না এবং সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

কিন্তু এক দশকেরও কম সময়ে পশ্চিমাদের সেই ধারণা ভেঙে যায়। দুর্বল বিশ্লেষণের পাশাপাশি অহংকার, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও অজ্ঞতার কারণে পর পর তিনটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। দেরিতে হলেও ইরাক যুদ্ধে বিপুল সেনা ক্ষয় ও অর্থের অপচয় এবং মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়টি টের পেয়ে একসময় হুট করে নিজেদের সরিয়ে নেয় মার্কিনরা। এক দশক পর একইভাবে আফগানিস্তান ছাড়ে তারা।

কিন্তু সিরিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে ইরাকে করা ভুলের পুনরাবৃত্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এবার সরাসরি আগ্রাসন চালায়নি দেশটি। সিরিয়ায় সরকারবিরোধীদের মদদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটনের জন্য বুমেরাং হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো শক্তি সঞ্চয় ও প্রভাব বিস্তার শুরু করে। 

এ ছাড়া সিরিয়া রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করে। শেষে দেখা গেল ইরান আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এটা সহজেই বোধগম্য, আগামী বছর অনুষ্ঠেয় মার্কিন নির্বাচনের আগে মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সক্রিয় হতে চাইছেন জো বাইডেন। হোয়াইট হাউস প্রমাণ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্রের এখনো মধ্যস্থতা করার সক্ষমতা রয়েছে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker