২৯ বছর বয়সী সানিয়া খান যখন তার স্বামীকে ছেড়ে ডিভোর্সের পথ বেছে নেন, তখন তার দক্ষিণ এশিয় মুসলিম আত্মীয়স্বজন তাকে বলার চেষ্টা করেছিলেন যে তিনি জীবনে ব্যর্থ হয়েছেন। এই কঠিন সময়ে তিনি সান্ত্বনা খুঁজে পান টিকটকে অজানা ব্যক্তিদের সাথে দুঃখের কথা ভাগাভাগি করে। কিন্তু সেটাই যেনো কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। নিজের প্রাক্তন স্বামীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন তিনি।
২০২২ সালের ২১ জুলাই সানিয়ার কথা ছিল একটি ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের ট্রমাকে ফেলে নতুন জীবন শুরু করার। কে জানত, সেদিনই কফিনে করে বাড়ি ফিরতে হবে তাকে।
এর তিনদিন আগে শিকাগোতে নিজের কন্ডোমিনিয়াম এপার্টমেন্টের দরজার কাছে সানিয়ার মরদেহ খুঁজে পায় পুলিশ। তার মাথার পিছন দিকে গুলির আঘাত ছিল। পুলিশ আসার পর নিজেকে গুলি করেন তার স্বামী রাহিল আহমেদ।
পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই দম্পতির ডিভোর্স প্রক্রিয়াধীন ছিল। সেপারেশনের সময় অন্য রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন রাহিল। তবে এই ‘সম্পর্ককে বাঁচাতে’ প্রায় সাতশ’ মাইল পাড়ি দিয়ে শিকাগোতে ফিরে যান তিনি।
সানিয়া খান ছিলেন একজন পাকিস্তানি-আমেরিকান ফটোগ্রাফার। দক্ষিণ এশিয় নারীদের বিয়ে সম্পর্কিত ট্রমা ও ডিভোর্স স্টিগমার বিরুদ্ধে কথা বলে টিকটকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
বিয়ে, ম্যাটার্নিটি শুট, বেবি শাওয়ার ও অনান্য ব্যক্তিগত মাইলফলকের মুহূর্তগুলোর ছবি তুলতেন সানিয়া। নিজের কাজ ও জীবন সম্পর্কে তার দর্শন নিয়ে ধারণা পয়া যায় তার তার ইন্সটাগ্রাম বায়ো থেকে, যেখানে লেখা ছিল- ‘ক্যামেরার সামনে নিজেকে ও একে অপরকে ভালোবাসতে সাহায্য করি আমি।’
সানিয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড মেহরু শেখ তার সম্পর্কে বলেন, ‘ক্যামেরার পেছনে ও ছিল সবচেয়ে প্রাণবন্ত। মানুষকে ক্যামেরার সামনে সহজ-স্বাভাবিক ও খাঁটি আনন্দ অনুভব করাতে সে ছিল পারদর্শী।’
নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও এই আনন্দেরই খোঁজ করেছেন সানিয়া। পাঁচ বছরের সম্পর্কের পর ২০২১ সালের জুনে রাহিলকে বিয়ে করে তারা একসাথে শিকাগোতে বসবাস শুরু করেন।
সানিয়ার ছোটবেলার এক বন্ধু বলেন, ‘অসাধারণ এক পাকিস্তানি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওরা বিয়ে করে। কিন্তু এই সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো হয়েছিলো মিথ্যের ভিতের ওপর।’
সানিয়ার বন্ধুদের দাবি, বিয়ের অনেক আগে থেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন রাহিল। বিয়ের আগে অনেকটা সময়ই তারা কাটান লং ডিসট্যানস সম্পর্কে, যার ফলে তারা বুঝতে পারেননি আসলে তারা একে অপরের জন্য কতটা অনুপযোগী।
তাদের মধ্যকার সমস্যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় গত ডিসেম্বরে। রাহিলের মানসিক সংকটের কারণে সানিয়া অনিরাপদ বোধ করছিলেন বলে তার বন্ধুদের জানান তিনি।
বহু নারী সম্পর্কে পার্টনারের হাতে নিপীড়নের শিকার হন। এর জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয় মানসিক সমস্যা ও সম্পর্কের জটিলতাকে। পারিবারিক সহিংসতা বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন নারী পার্টনারের হাতে খুন হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন যখন তিনি সম্পর্কটি ভাঙতে যান।
ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত রাহিলের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারগুলো কারও কাছে প্রকাশ করেননি সানিয়া। তবে এরপর তিনি এই অসুখী সম্পর্ক নিয়ে মুখ খোলার সিদ্ধান্ত নেন।
সানিয়ার বন্ধুরা বলেন, সাহিলের মানসিক সমস্যা নিয়ে তিনি যখন তাদের সাথে আলোচনা করেন তখন তারা তাকে রাহিলকে ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে এমন অনেকেই ছিলেন যারা তাকে রাহিলের সাথেই থাকার পরামর্শ দেন।
সানিয়ার আরেক বন্ধু ব্রিয়ানা উইলিয়ামস বলেন, মে’তে যখন সানিয়ার সাথে তার শেষ দেখা হয় তখন সানিয়া বলেন যে তিনি অত্যন্ত একা বোধ করছেন। ‘মানুষ কি বলবে’, এই কথাটি বারবার বলছিলেন তিনি।
সানিয়া নিজেও ছিলেন ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তান। ‘ডিভোর্সি’ নারীরা দক্ষিণ এশিয় সমাজে যে ধরণের অপমানের শিকার হন, সেটি সামনে থেকে দেখেই হয়তো ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে এতো ইতস্তত বোধ করছিলেন তিনি।
শিকাগোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আপনা ঘার’-এর নির্বাহী পরিচালক নেহা গিল বলেন, ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলোকে বাইরে থেকে কেমন দেখায় তা নিয়ে ব্যাপক সাংস্কৃতিক চাপ রয়েছে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার দক্ষিণ এশিয় নারীদের সহায়তা করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
নেহা গিল আরও বলেন, অনেক দক্ষিণ এশিয় কমিউনিটিতেই এখনও নারীদের নিকৃষ্ট মনে করা হয় ও তাদের নিয়ন্ত্রণ করাকে সমুচিত মনে করা হয়। এসব কমিউনিটির সংস্কৃতি এখনও সাম্প্রদায়িক। তাই সেখানে একজন মানুষের নিরাপত্তা ও ভালো থাকার চেয়ে পরিবার ও সমাজকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
তবে বন্ধুদের সহায়তায় এক পর্যায়ে রাহিলকে ডিভোর্স দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন সানিয়া। আর নিজের গল্প ভাগাভাগি করে নেন টিকটক ফলোয়ারদের সাথে।
সেখানে একজন দক্ষিণ এশিয় নারী হিসেবে ডিভোর্সের পর যেসব স্টিগমা ও অপমানের শিকার হতে হয় তা নিয়ে কথা বলতেন তিনি। টিকটকে প্রায় ২০ হাজার ফলোয়ার ছিল তার।
তাদেরই একজন বিসমা পারভেজ। তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় নারীদেরকে বলি নিজেরকে রক্ষা করতে। কিন্তু ছেলেদেরকে মেয়েদের সম্মান করতে শেখানোটাও জরুরি। এই চর্চা শুরু করতে হবে প্রতিটি পরিবার থেকেই।’