ঢাকাই চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় চিত্রনায়ক মান্না। অসংখ্য ভক্তকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে চলে যান এক সময়ের এই ঢালিউড কিং। মৃত্যুর পরও তার জনপ্রিয়তা এখনো অমলিন। চিত্রনায়ক মান্নার আকস্মিক মৃত্যু তখন কেউই মেনে নিতে পারেননি। তার মৃত্যুর এতদিন পরও সেই ক্ষত আজও শুকায়নি।
আজ (১৭ ফেব্রুয়ারি) চিত্রনায়ক মান্নার ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ভক্ত ও সহকর্মীরা স্মরণ করেছেন ও দোয়া চেয়েছেন। এদিকে তার পরিবারের পক্ষ থেকেও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে।
মান্না নামে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে পরিচিত হলেও তার পুরো নাম এস এম আসলাম তালুকদার।
সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার, মঞ্চনাম মান্না হিসাবেই অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশী চলচ্চিত্র অভিনেতা ও প্রযোজক। মাত্র চব্বিশ বছরের কর্মজীবনে তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।
‘বীর সৈনিক’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসাবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও তিনবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন এবং বেশ কয়েকবার বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন।
তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘দাঙ্গা’, ‘কাসেম মালার প্রেম’, ‘আম্মাজান’, ‘শান্ত কেন মাস্তান’, ‘কষ্ট’, ‘বীর সৈনিক’, ‘অবুঝ শিশু’, ‘সাজঘর’, ‘উত্তরের খেপ ও কাবুলিওয়ালা’ ইত্যাদি অন্যতম।
মান্না ১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নুরুল ইসলাম তালুকদার ও মাতা হাসিনা ইসলাম। মান্না উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে ঢাকা কলেজে স্নাতকে ভর্তি হন।
ব্যক্তিগত জীবনে তার কর্মজীবনের শুরুর দিকের সহ-অভিনেত্রী শেলী কাদেরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির সিয়াম ইলতিমাস মান্না নামে এক পুত্র সন্তান রয়েছে।
মান্না ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (এফডিসি) আয়োজিত ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমে নির্বাচিত হন।
১৯৮৫ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত পাগলী চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। যদিও তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র তওবা।
এরপর তিনি টানা আরো কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘কাসেম মালার প্রেম’ চলচ্চিত্রে প্রথম একক নায়ক হিসেবে চম্পার বিপরীতে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হলে, তিনি কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করারও সুযোগ পান।
এরপর ১৯৯২ সালে কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ ও ‘ত্রাস’ চলচ্চিত্রেও একক অভিনেতা হিসাবে সফলতা পান তিনি। একই বছর তার অভিনীত মোস্তফা আনোয়ারের ‘অন্ধ প্রেম’, ‘মনতাজুর রহমান আকবরের প্রেম দিওয়ানা’ ও ‘ডিস্কো ড্যান্সার’, কাজী হায়াতের ‘দেশদ্রোহী’, মনতাজুর রহমান আকবরের ‘বাবার আদেশ’, অশোক ঘোষের ‘শাদী মোবার’ , বুলবুল আহমেদের ‘গরম হাওয়া’, সাইফুল আজম কাশেমের ‘সাক্ষাৎ’, কামাল আহমেদের ‘অবুঝ সন্তান’, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘গরীবের বন্ধু’ চলচ্চিত্রগুলো মুক্তি পায়।
মান্না ১৯৯৭ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘লুটতরাজ’ চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেন, যেখানে তার বিপরীতে অভিনয় করেন মৌসুমী ও দিতি। চলচ্চিত্রটি ব্যবসায়িকভাবে সফলতাও পেয়েছিল।
১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যেখান তার সঙ্গে অভিনয় করেন শবনম, আমিন খান ও মৌসুমী। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি প্রথম বাচসাস পুরস্কার ও মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন। একই বছর তিনি রায়হান মুজিব ও আজিজ আহমেদ বাবুল পরিচালিত ‘খবর আছে’, মালেক আফসারীর ‘লাল বাদশা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যা তিনি প্রযোজনাও করেছেন।
২০০০ সালে তার প্রযোজিত তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘আব্বাজান’ মুক্তি পায়। এটি দুটি বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করে।
২০০৩ সালে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীভিত্তিক ‘বীর সৈনিক’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
মান্না অভিনয়ের পাশাপাশি কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন। তিনি ‘কৃতাঞ্জলী’ চলচ্চিত্র নামে একটি প্রযোজনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘লুটতারাজ’, ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’, ‘দুই বধু এক স্বামী’, ‘আমি জেল থেকে বলছি’, ‘পিতা মাতার আমানত’সহ মোট আটটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসাবেও বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
মান্না ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
মান্নার স্মরণে তার এক অন্ধ ভক্তের কাহিনী নিয়ে মালেক আফসারী পরিচালিত জায়েদ খান ও পরিমনি অভিনীত ‘অন্তর জ্বালা’ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। বিএফডিসিতে তার নামে ‘মান্না ডিজিটাল কমপ্লেক্স’ হিসাবে একটি ভবন নামকরণ করা হয়। এছাড়াও তার স্মৃতি স্মরণে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন নিয়মিত মান্না উৎসব আয়োজন করে থাকে।
এছাড়া তার জন্ম ও মৃত্যু দিবসে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো স্মৃতিচারণমূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে।